কাজলের ঘটনাটি তেসরা মে তারিখেই কেন ঘটলো?

Spread the love

আমীন আল রশীদ: প্রথমে সংবাদটি ছিল স্বস্তির। কারণ প্রায় দুই মাস নিখোঁজ থাকার পরে ফটোসাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলের সন্ধান মিললো এমন একটি দিনে, যে দিনটি শুধু বাংলাদেশ নয়, বরং সারা বিশ্বের সাংবাদিকদের জন্যই তাৎপর্যপূর্ণ। তেসরা মে, বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস। ফলে সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকে সাংবাদিক কাজলের এই সন্ধান পাওয়াকে ‘মুক্ত গণমাধ্যম দিবসের উপহার’ বলেও মন্তব্য করেন। কিন্তু নাটকের মূল অংশটি তখনও মঞ্চস্থ হয়নি। জানা গেলো, কাজল নাকি ভারত থেকে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছেন এবং সেই অনুপ্রবেশের দায়ে তাকে গ্রেপ্তার করেছে বিজিবি। এরপর আদালতের মাধ্যমে কাজলের জামিনের চেষ্টা।
এই করোনার দুঃসময়ে যখন মানবিক বিবেচনায় স্বয়ং বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেয়া হলো, যখন দীর্ঘদিন ধরে কারাভোগকারীদের মধ্য থেকে বাছাই করে অনেক আসামিকে মুক্তির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার, তখন একটি হাস্যকর অভিযোগে দায়ের করা মামলায় কাজলকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
আদালত অন্প্রুবেশের মামলায় কাজলকে জামিন দিলেও বাংলাদেশের ফৌজদারি কার্যবিধির সবচেয়ে বিতর্কিত ৫৪ ধারায় দায়ের করা মামলায় আদালত তাকে জামিন না দিয়ে কারাগারে পাঠান। কেন তাকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করা হলো তার ব্যাখ্যা দিয়ে যশোর কোতোয়ালি থানার ওসি মনিরুজ্জামান গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তার বিদ্ধে রুতনটি মামলা আছে বলে তাকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং কারাগারে রাখা হচ্ছে। যাতে সংশ্লিষ্ট আদালত তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করতে পারে এবং তাকে ঢাকায় নিয়ে যেতে পারে। তাকে যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছে, যেখানে তিনি ১৪ দিন কোয়ারেন্টিনে থাকবেন।’

অধস্তন আদালত কাকে জামিন দেবেন বা না দেবেন, সেটি একান্তই তার এখতিয়ার। উচ্চ আদালতে এটি চ্যালেঞ্জ করার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু করোনা পরিস্থিতির কারণে উচ্চ আদালতের কার্যক্রম বন্ধ থাকায় সেখানেও যেতে পারছে না কাজলের পরিবার। এখন যে প্রশ্নটি সামনে আসছে তা হলো, আদালত বন্ধ থাকলে কি মানুষের ন্যায়বিচার পাওয়ার বন্ধ থাকবে? বরং যতক্ষণ সংবিধান কার্যকর, ততক্ষণ পর্যন্ত এর দ্বারা অনুমোদিত সব মৌলিক অধিকার নাগরিকের প্রাপ্য। আদালত বন্ধের কারণে একজন নাগরিক ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হতে পারেন না।

তবে এইসব আলোচনার বাইরেও সাংবাদিক কাজলকে নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আচরণ, বিশেষ করে দাগি আসামি বা দুর্র্ধষ সন্ত্রাসীর মতো হাতকড়া পরিয়ে তাকে আদালতে নিয়ে যাওয়ার যে দৃশ্য গণমাধ্যমে এসেছে, সেটি বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসের চেতনায় সজোরে চপেটাঘাত বৈ কিছু নয়।

সাংবাদিক কাজলের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে এবং তাকে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত থেকে অনুপ্রবেশের সময় আটকের যে দাবি করা হচ্ছে, তার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। এটাই বাস্ততা যে, কাজলকে কোনো একটি প্রভাবশালী মহলের নির্দেশে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল এবং তাকে আটকে রেখে তার কাছ থেকে নানা বিষয়ে জবানবন্দি নেয়া হয়েছে। তাকে মেরে ফেলার হুমকি দেয়া হয়েছে। হয়তো মেরে ফেলাই হতো। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়া এবং আন্তর্জাতিক চাপে হয়তো সেই গোষ্ঠী হত্যার মতো চূড়ান্ত পথে না গিয়ে তাকে জীবিত ফেরত দিলো। কিন্তু কাজল যাতে সাংবাদিক এবং দেশের সাধারণ মানুষের সহানুভূতি না পান, সেজন্য তাকে ভারত থেকে অনুপ্রবেশের মতো একটি বায়বীয় এবং ৫৪ ধারার মতো একটি প্রশ্নবিদ্ধ ধারায় গ্রেপ্তার দেখানো হলো।
তাতে কি কাজলের প্রতি সহানুভূতি কমলো না বাড়লো? বরং এর আগেও তার মতো নিখোঁজ ব্যক্তিদের অনেকে যেভাবে ফিরে এসেছেন, যেমন রাস্তায় পাশে ফেলে দেয়ার পরে নিকটস্থ থানায় গিয়ে সহায়তা চাওয়া এবং তারপর পরিবারের লোক গিয়ে তাকে নিয়ে এসেছেন, কাজলের ক্ষেত্রে সেটি করা হলে মন্দ হতো না। বরং শুরুতে সাংবাদিকরা যেমন তার সন্ধান পাওয়ার ঘটনাটিকে মুক্ত গণমাধ্যম দিবসের উপহার হিসেবে ভেবেছিলেন, সেটিই ভালো হতো।
আর স্বাভাবিকভাবেই যেহেতু ধরে নেয়া যায় যে, কাজল এই প্রায় দুই মাস কোথায় ছিলেন, কারা তাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল, তার সাথে কী আচরণ করা হয়েছে, কোন কোন বিষয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে এবং সবশেষ কোন শর্তে তাকে ছেড়ে দিলো, সেসব বিষয়ে তিনি যেহেতু মুখ খুলতেন না বলেই ধরে নেয়া যায়, অতএব এটিও নিখোঁজের পরে ফিরে আসা অন্যান্য ব্যক্তিদের মতো একটি ঘটনা হিসেবেই বিবেচিত হতো।
বিনিময়ে অন্তত কাজলের পরিবারে স্বস্তি ফিরে আসতো। কিন্তু তা না করে কাজলকে দুটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো এবং তারপর জেলখানায় পাঠানোর রহস্যটি এখনও পরিস্কার নয়। তার মানে কি এই যে, যে প্রভাবশালী মহলের নির্দেশে কাজলকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়, কাজলের ওপর তাদের রাগ ক্ষোভ এখনও কমেনি? নাকি তারা কাজলকে এমন একটা শিক্ষা দিতে চান যাতে তিনি ভবিষ্যতে কোনোদিন সাংবাদিকতার নামও মুখে না আনেন? উল্লেখ্য, তার বিরুদ্ধে রাজধানীর তিনটি থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেও তিনটি মামলা হয়েছে এবং সবগুলোর বাদী প্রভাবশালীরা। সুতরাং খুব সহজে সাংবাদিক কাজলের দুর্দিন যে শেষ হচ্ছে না, তা চোখ বন্ধ করেই বলে দেয়া যায়। কারণ তিনি কাদের রোষানলে পড়েছেন, তা এরইমধ্যে সবাই জেনে গেছেন।

প্রশ্ন হলো, যারা প্রায় দুই মাস ‘আটকে রাখার’ পর কাজলকে ক্যামেরার সামনে নিয়ে এলেন, তারা কি সচেতনভাবেই তেসরা মে তারিখটাকে বেছে নিলেন যাতে বাংলাদেশে মুক্ত গণমাধ্যমের চেহারাটা আসলে কেমন, সেটি বোঝানো যায়? তারা কি জেনেবুঝেই বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসে একজন সাংবাদিককে হাতকড়া পরিয়ে দাগি আসামির মতো আদালতে গিয়ে গেলেন এটি বোঝানোর জন্য যে, বাংলাদেশের সাংবাদিকতা আসলে এরকমই শেকলেবাঁধা? তারা কি আন্তর্জাতিক বিশ্বকেও এই বার্তা দিলেন যে, বাংলাদেশের সাংবাদিকদের নির্যাতন বা হত্যা করলেও তার কোনো বিচার হবে না, এমনকি সেটি বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসে হলেও না? নাকি তারা কাজটা না বুঝেই করেছেন এবং কাকতালীয়ভাবে তেসরা মে তারিখেই ঘটনাটি ঘটে গেলো?

আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, রংধনু টেলিভিশন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *