সৈয়দ জুয়েল: বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই স্বাস্থ্য সেবার আধুনিকায়নে জোগ হয়েছে নতুন নতুন প্রযুক্তি ও তার ব্যাবহার। রোগীদের সেবার মানও বেড়েছে বহুগুন। এদিক থেকে অনেকটাই পিছিয়ে আমরা। দিন যতই যাচ্ছে চিকিৎসা সেবার মান ততই নিম্নগামী হচ্ছে। করোনা ভাইরাস এসে বুঝিয়ে দিয়ে গেল- কতটা অসহায় আমাদের চিকিৎসা ব্যাবস্থা। যেখানে কম পক্ষে এক হাজার মানুষের জন্য একজন ডাক্তার থাকাটা জরুরী,সেখানে দুই হাজার পাঁচশত জনের জন্য আমাদের একজন ডাক্তার। আবার আমাদের যেখানে দেড় লক্ষ ডাক্তার থাকার কথা ছিল, সেখানে আমাদের রেজিস্ট্রকৃত সত্তর হাজার সরকারী বেসরকারী পর্যায়ে ডাক্তার আছেন।
এই সত্তর হাজার ডাক্তারের ভিতর মাত্র তিরিশ হাজার ডাক্তার আছেন সরকারী, বাকী চল্লিশ হাজারই বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোয়। হাসপাতালগুলোতেও রয়েছে হাজারো সমস্যা। পয়ঃনিস্কাশন ব্যাবস্থা, আই,সি,ইউ সমস্যা, সেবিকা শংকট, ঔষধ বিতরনে অনিয়ম, শরীর পরীক্ষার যন্ত্রপাতির স্বল্পতা। যতটুকু আছে, অব্যাবস্থাপনা আর দূর্নীতিতে তলিয়ে যাচ্ছে ততটুকুও।
স্বাস্থ্য খাতে যে বরাদ্দ আসে তার অধিকাংশই চলে যায় বেতন ভাতা সহ পরিচালনার খাতে। বাকীটুকু খরচ করা হয় উন্নয়ন খাতে,যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। উন্নয়ন খাতে এই অপ্রতুলতাই স্বাস্থ্য বিভাগের উন্নত সেবার ক্ষেত্রে বড় এক বাঁধা। তবে আমাদের নৈতিকতা বোধের অবক্ষয়ও স্বাস্থ্য খাত ধ্বংসের বড় এক কারন। সরকারী বরাদ্দর পুরোটা অংশ যদি সঠিক ব্যাবহার হত, তাহলে সেবাখাতের চেহারাটাই পাল্টে যেত।
শুধু সরকারের একার পক্ষে প্রতিটি জায়গা সংস্কার করা সম্ভপর নয়, দরকার সন্মিলিত প্রচেস্টার। সরকারী হাসপাতালের পরিচালক থেকে ডাক্তার, নার্স, ওয়ার্ড বয় পর্যন্ত কারো কাছ থেকে সঠিক সেবাটা কখনই পায়না রোগীরা। সরকারী বেতন নিয়েও অনেক ডাক্তারই হাসপাতালগুলোয় কম হাজিরা দিয়ে প্রাইভেট ক্লিনিকগুলোতে সেবা দিচ্ছেন, আবার প্রাইভেট চেম্বারও খুলেও ওখানেও সময় দিচ্ছেন। কিন্তু দ্য মেডিকেল প্রাকটিস এন্ড প্রাইভেট ক্লিনিকস এন্ড ল্যাবরেটরীজ ১৯৮২ সালের আইনের চার ধারায় সরকারী চাকুরীরত অবস্থায় প্রাইভেট হাসপাতাল, ক্লিনিক, নার্সিং হোমগুলোতে প্রাকটিস করতে পারবেনা কোন ডাক্তার। আইনটির ১৩ ধারায় জেল জরিমানার বিধানও রাখা হয়েছে। কিন্তু এ আইনটি অলস পরে আছে, এর কোন প্রয়োগ নেই। সরকারী যে ঔষধগুলো বিনামূল্যে রোগীদের দেয়ার জন্য সরকার পাঠিয়ে থাকেন, তার ছিটেফোঁটাও সাধারন রোগীদের ভাগ্যে জুটেনা। এক অক্সিজেন সিলিন্ডারের পাইপ ছিদ্র করে তিনটি পাইপ জোড়া দিয়ে তিনজন রোগীকে অক্সিজেন দেয়ার নামে তিনজনই রোগী মেরে ফেলার দাম্ভিকতার রেকর্ডও আছে সরকারী হাসপাতালগুলোতে। শৌচাগার গুলোতে কোন সুস্থ মানুষও যাওয়ার কোন অবস্থা নেই। এই শৌচাগারগুলো কি আদৌ মানুষে ব্যাবহারের উপযোগী? ভাবেনা কতৃপক্ষ। বছরে বছরে সরকারী বরাদ্দর লুটপাটের এক মহা উৎসবে মেতে ওঠে সরকারী হাসপাতালের দায়িত্বে থাকা রাঘব বোয়ালরা। চুনি পুটিরাও এ ভাগের ভাগীদার। স্বাস্থ্য বিভাগের এই বিপর্যয়ের জন্য স্বাধীনতার পর থেকে প্রায় প্রতিটি সরকারই দায়ী। আজ এর কুফল ভোগ করছেন দেশের প্রতিটি স্তরের নাগরিকরা।
করোনায় বিদেশ ভ্রমন বন্ধ থাকায় ধনী শ্রেনীর মানুষরাও এখন বাধ্য হয়ে বেসরকারী হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। সরকারী হাসপাতালের বেহাল দশায় এ পথে কেউ পা মাড়ায়না। আজ যদি সরকারী হাসপাতালগুলোকে ঢেলে সাজানো যেত, এর সুফল হাঁচি আসলে যারা সিঙ্গাপুরে যান, তারাও পেত। প্রাইভেট হাসপাতাল তৈরীতে কোন সরকারেরই কোন কৃতিত্ব নেই। এটা ব্যাক্তি মালিকানাধীন। দরিদ্র জনগোষ্ঠী থেকে সমাজের উঁচু তলার মানুষের সেবার জন্য সরকারী হাসপাতালগুলোকে ঢেলে সাজাতে হবে, দরকার হলে নতুন আইন ও তার প্রয়োগে কঠোর হতে সরকারকে। দেশের মন্ত্রী, আমলা, সংসদ সদস্য, শিল্পপতিদেরকে সরকারী হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা নিতে বাধ্যতামূলক করা হলে এ খাতে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে বলে ধারনা অভিজ্ঞজনদের। সেবার মানে কতটা বিপর্যয় ঘটেছে, তখন নীতি নির্ধারকরা বুঝতে পারবেন বলেও মত তাদের। একটি সুন্দর জাতি গঠনে জনগনের সুস্থতা অপরিহার্য। আর সুস্থ থাকতে হলে দরকার একটি স্বাস্থ্যনীতির সঠিক প্রয়োগ। আমরা চাইনা কোন অবহেলার মৃত্যু। স্বাভাবিক মৃত্যুর স্বস্তিতে পুরো সমাজ ব্যাবস্থায় আসবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন, যার সুফল পাবেন রাস্ট্রের প্রতিটি নাগরিক। মৃত্যুর পূর্বের শেষ নিঃশেষটুকু হয় যেন সেবা দিয়ে ভরা এক ভালবাসা, আর শেষবারের দৃস্টি মেলে যেন দেখতে পায় রাস্ট্র তাকে বাঁচানোর আঁকুতির প্রতিচ্ছবি।
২০২০-০৬-১০