আম লিচুর ব্যবসা থেকে মাস্ক সরবরাহকারী, কে এই শারমিন

Spread the love

নাগরিক ডেস্ক : শারমিন জাহান ওরফে জাহানারা। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসন-১ এর সহকারী রেজিস্ট্রার। এ ছাড়া নিজেকে রাজনীতিবিদ, উদ্যোক্তা, লেখক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠক হিসেবে পরিচয় দেন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সংরক্ষিত নারী আসনের জন্য নেত্রকোনা-৫ আসন থেকে মনোনয়ন চেয়েছিলেন। এ ছাড়া চাকরির নিয়মনীতি লঙ্ঘন করে হয়েছেন বেসরকারি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের মালিক। প্রতিষ্ঠানের নাম অপরাজিতা ইন্টারন্যাশনাল। প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে তিনি আম, লিচু, সবজি থেকে শুরু করে মাছ, মাংস, হাঁস- মুরগি বিক্রি করতেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারণা চালিয়ে বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করতেন।
২০১৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে পিএইচডি করতে গিয়েছিলেন চীনের উহানে। সেখানে করোনার তাণ্ডব শুরু হওয়ার পরপরই চলে আসেন দেশে। দেশে এসে অন্যান্য পণ্যের পাশাপাশি করোনাকালীন সময়ে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে বিক্রি শুরু করেন সুরক্ষা সামগ্রী। আদতে তিনি খুচরা বিক্রেতা। বিভিন্ন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে সুরক্ষা সামগ্রী এনে ফেসবুক ও ঘনিষ্ঠ মহলে প্রচারণা চালিয়ে অল্প কিছু পণ্য বিক্রি করতেন। কিছুদিন পর বেশি লাভের জন্য নতুন ফন্দি বের করেন। নিজের রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানেও সুরক্ষা সামগ্রী থার্মোমিটার, পিপিই, মাস্ক, গ্লাভস, ফেইস শিল্ডসহ অন্যান্য পণ্য সরবরাহ শুরু করেন। গণমাধ্যমে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি নিজেই বলেছেন, ঢাকা ডিসি অফিস থেকে শুরু করে পুলিশ প্রশাসনেও তিনি নিয়মিত সুরক্ষা সামগ্রী দিয়ে আসছিলেন। তবে সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও বাগড়া বাধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে মাস্ক সরবরাহে। সেখানকার কোভিড চিকিৎসকদের জন্য ১১ হাজার মাস্ক সরবরাহের কাজ পেয়েছিলেন তিনি। এরমধ্যে সরবরাহ করেছিলেন ৩ হাজার ৪৬০টি। কিন্তু এন-৯৫ মাস্কের আড়ালে তিনি ৯৫৯টি নকল মাস্ক সরবরাহ করেছেন। চিকিৎসকরা বিষয়টি টের পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করেন। পরে সত্যতা নিশ্চিত হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর বাদী হয়ে শাহবাগ থানায় মামলা করেন। এই মামলায় শুক্রবার শারমিনকে শাহবাগ এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ।

এদিকে নিম্নমানের মাস্ক সরবরাহ করে প্রতারণার অভিযোগে গ্রেপ্তার অপরাজিতা ইন্টারন্যাশনালের মালিক শারমিন জাহানের তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। গতকাল ঢাকা মহানগর হাকিম মঈনুল ইসলাম এ রিমান্ডের আদেশ দেন। রাষ্ট্র পক্ষে সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর হেমায়েত উদ্দিন খান হিরণ রিমান্ড মঞ্জুরের প্রার্থনা করে শুনানি করেন। আর আসামি পক্ষে অ্যাডভোকেট কাজী পনির হোসেন রিমান্ড বাতিল চেয়ে জামিন আবেদন করেন। তিনি বলেন, আসামি ঘটনার সঙ্গে জড়িত না। তিনি ট্রেনিংয়ে চীনের উহানে ছিলেন। ট্রেনিং শেষ করে দেশের সেবা করতে এসেছেন। এর আগে তিনি সেখানে ফেস মাস্ক সরবরাহ করেছেন। যে ঘটনার জন্য মামলা হলো সেই ফেস মাস্ক তিনি ঘটনার এক মাস আগে সরবরাহ করেছেন। তখন কোনো অভিযোগ করা হয়নি। এক মাস পরে এসে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হলো। বড় ধরনের কোনো অন্যায়কারীকে বাঁচানোর জন্য শারমিন জাহানকে ফাঁসানো হয়েছে। শুনানির এক পর্যায়ে বিচারকের অনুমতি নিয়ে শারমিন জাহান আদালতকে বলেন, আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেস মাস্ক সরবরাহ করি। চার লটের মধ্যে দুটোই ভালো। আর যেগুলো খারাপ সেগুলো আমাকে ফেরত দিতো র্র্কর্তৃপক্ষ। এক মাস আগে দেয়া মালের অভিযোগ ১৮ তারিখে তারা আমাকে জানিয়েছে। আমি চীনের উহানে ছিলাম। ট্রেনিং শেষে দেশে ফিরে মানুষের সেবা করতে কাজ করছি। শুনানি শেষে আদালত ত্যাগ করার সময় শারমিন জাহান সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে বলেন, আমি ষড়যন্ত্রের শিকার। আপনারা এর আসল সত্য উদ্ঘাটন করুন।

মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট ও হাসপাতালসূত্রে জানা গেছে, শারমিন জাহান রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে হাসপাতাল থেকে মাস্ক সরবরাহের কাজ বাগিয়ে নিয়েছেন। কাজ পেতে তিনি হাসপাতাল প্রশাসনের দুজন কর্মকর্তার সঙ্গে যোগসাজশ করেন। এদের মধ্যে হাসপাতালের পরিচালক ও একজন সহকারী পরিচালক রয়েছেন। শুধু মাস্ক নয়, করোনাকালীন সময়ে আরো অনেক কেনাকাটা এই দুই কর্মকর্তাই নিজেদের খেয়াল খুশিমতো করেছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। এও অভিযোগ উঠেছে শারমিনকে কাজ দেয়ার ক্ষেত্রে মানা হয়নি কোনো টেন্ডার প্রক্রিয়া। করা হয়নি মাস্কের গুণগত মানের যাচাই বাছাই। ৭৩০ টাকা দরে প্রায় ৮০ লাখ টাকার মাস্ক সরবরাহের কথা ছিল প্রতিষ্ঠানটির। তদন্ত সংশ্লিষ্টসূত্র বলছে, শারমিন জাহানের পক্ষে একা এই কাজ করা সম্ভব না। তার সঙ্গে আরো অনেকে জড়িত থাকতে পারেন।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের রমনা জোনের অতিরিক্ত উপ- পুলিশ কমিশনার মিশু বিশ্বাস বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দায়ের করা মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করে গতকাল আদালতে হাজির করে রিমান্ড চাওয়া হয়। রিমান্ডে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এই ঘটনার সঙ্গে আর কেউ জড়িত কিনা সেটিও খতিয়ে দেখা হবে।

ওদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করে কীভাবে শারমিন প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের মালিক হয়েছেন এই প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন মহলে। কারণ ঢাবিতে চাকরির নীতিমালা অনুযায়ী চাকরির পাশাপাশি ব্যবসা করার সুযোগ নেই।

কে এই শারমিন:

শারমিন জাহানের বাড়ি নেত্রকোনা জেলার পূর্বধলার শ্যামগঞ্জের গোয়ালকান্দায়। তার পারিবারিক নাম জাহানারা। চার ভাই ও তিন বোনের মধ্যে তিনি সবার ছোট। শারমিন স্কুল ও কলেজ দুটোই শেষ করেছেন শ্যামগঞ্জে। ১৯৯৬ সালে এসএসসি ও ১৯৯৮ সালে হাফেজ জিয়াউর রহমান মহাবিদ্যালয় থেকে এইচএসসি পাস করেন। এই মহাবিদ্যালয় থেকেই তার ছাত্র রাজনীতি শুরু হয়। ১৯৯৬ সালেই কলেজে ভর্তি হয়েই শারমিন ছাত্রলীগের পক্ষে কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচন করেন। ওই নির্বাচনে তিনি সম্পাদিকা হিসেবে নির্বাচিত হন। এরপর থেকে ক্যাম্পাস রাজনীতির সব কিছুতেই তার সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। এইচএসসি’র পর অর্থনীতি নিয়ে ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজে ভর্তি হন। সেখানে কিছুদিন পড়ালেখার পর ১৯৯৮-১৯৯৯ শিক্ষাবর্ষের ইসলামিক স্টাডিজে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। জায়গা হয় তার বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হলে। ২০০০ সালের ২৫শে মে তিনি হলের প্রচার সম্পাদিকা হিসেবে নির্বাচিত হন। এরপর ২০০২ সালে তিনি এই হল ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতেও জায়গা হয় শারমিনের। আর সর্বশেষ তিনি আওয়ামী লীগের মহিলা ও শিশু বিষয়ক কেন্দ্রীয় উপ-কমিটিতে ছিলেন। তার আগের কমিটিতে তিনি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপ-কমিটিতে সহ-সম্পাদক পদে ছিলেন। লেখাপড়ায় থাকাকালীন ২০০৫ সালে শারমিন চাঁদপুরের বাসিন্দা যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা শাহ আলম ভূঁইয়ার ছেলে ব্যবসায়ী শরিফুল আলম ভূঁইয়াকে বিয়ে করেন। শারমিন এক মেয়ে ও এক ছেলের জননী। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৫ সালে রাজধানীর ধানমণ্ডির বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট থেকে হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্টে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা শেষ করেন। এরপর ২০১৬ সালে চীন সরকারের স্কলারশিপ পেয়ে বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের উপরে পিএইচডি করতে চীনের উহানে যান। উহান হোয়াজাং ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে ইতিমধ্যে প্রি ডিফেন্স সম্পন্ন করেছেন। ফাইনাল ডিফেন্স এখনো বাকি ছিল। করোনাভাইরাসের কারণে উহানে লকডাউন শুরু হলে ২৩শে জানুয়ারি তিনি দেশে ফিরে আসেন। চীনে থাকা অবস্থায় তিনি ২০১৯ সালের মার্চ মাসে অপরাজিতা ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি প্রতিষ্ঠান খুলে সরবরাহের ব্যবসা শুরু করেন। ২০১০ সালে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী রেজিস্ট্রার হিসেবে যোগদান করেন। চলতি বছরের ২৩শে জানুয়ারি ছুটি থেকে এসে ১৬ই মার্চ আবার কাজে যোগ দেন।

শারমিন জাহান ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন, ঢাকা ইউনিভার্সিটি সোসাইটি ফর হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট, বিআইএম অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন, ইসলামিক স্টাডিজ অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন, বঙ্গবন্ধু সমাজ কল্যাণ পরিষদ, ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল, নেত্রকোনা জেলা সমিতি, বৃহত্তর ময়মনসিংহ যুব সমিতি, চায়না আওয়ামী লীগসহ আরো বেশকিছু সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। শারমিনের এমন কর্মকাণ্ড জানাজানির পর এখন বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনসহ আওয়ামী লীগের মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি হয়েছে।

প্রসঙ্গত, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের করোনা ইউনিটে এন-৯৫ মাস্কের আড়ালে নকল মাস্ক সরবরাহ করার জন্য বৃহস্পতিবার রাতে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান অপরাজিতা ইন্টারন্যাশনালের মালিক শারমিন জাহানকে আসামি করে মামলা হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *