শয্যা নিয়ে কাড়াকাড়ি হয় বরিশাল মেডিকেলের শিশু ওয়ার্ডে

Spread the love

নাগরিক রিপোর্ট : ঘটনাটি রোববার বেলা আড়াইটার দিকে। বরিশাল শের-ই-বাংলা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় (শেবাচিম) হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডের ১২ নম্বর শয্যাটি ঘিরে ২জন নারীকে উচ্চবাচ্য করতে দেখা গেলো। বিছানার চাঁদর নিয়ে টানাটানি করছেন তারা। কয়েক মিনিট পর তাদের মধ্যে সমঝোতা হলে একটি শিশু রোগী নিয়ে শয্যায় ওঠেন অভিবাবকরা। তার পাশেই অসুস্থ্য শিশুসন্তানকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন বাকেরগঞ্জ উপজেলার সুন্দরকাঠী গ্রামের বাসিন্দা লোকমান হোসেন। গত শুক্রবার সন্তানকে ভর্তি করিয়ে শয্যা পাননি তিনি। থাকতে হচ্ছে মেঝেতে।

লোকমান হোসনে জানালেন, নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত ৩ মাসের সন্তান ফাতেমাকে মেঝেতে রাখায় আরও অসুস্থ্য হয়ে পড়ছে। তাই দিনের বেলা সন্তানকে কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়ান।

রোগীর স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেলো- উচ্চবাচ্যে লিপ্ত হওয়া দুই নারী ওয়ার্ডের বুয়া। নিয়োগ ছাড়াই রোগীদের নানা সেবাদিয়ে বকশিষ নেন। ১২ নম্বর শয্যাটি দেয়ার আশ্বাস দিয়ে দুইজন দুই রোগীর অভিবাবকদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছিলেন। তাই একজন রোগী ওঠাতে গেলে অন্যজন বাঁধা দেয়ায় দুজনের মধ্যে বচশা হয়। শয্যায় ওঠা রোগীর স্বজনরা জানালেন- ৪দিন ওয়ার্ডের মেঝেতে থাকার পর শয্যাটি পেতে বুয়াকে ১১০ টাকা দিতে হয়েছে।

শয্যা নিয়ে এরকম কাড়াকাড়ি-বাকবিতান্ডা দিনের একাধিকবার ঘটছে শেবাচিম হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে। এর কারন হিসাবে জানা গেছে, ওয়ার্ডটি ৩৬ শয্যার। গতকাল রোববারও ভর্তি রোগী ছিল ১২৭ শিশু। গত এক সপ্তাহ যাবত প্রতিদিন রোগীর সংখ্যা প্রায় একই রকম। নির্ধারিত শয্যার চেয়ে তিনগুনের বেশী রোগী। এজন্য একটি শয্যা পেতে স্বজনদের মধ্যে যেমন হাহাকার। অন্যদিকে হাসপাতালে ‘বুয়া’ নামধারীরা করছেন বানিজ্য।

শিশু ওয়ার্ডের সহকরী রেজিষ্ট্রার মশিউর রহমান তপু জানালেন, শীত মৌসুম শুরুর পরই ঠান্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত শিশু রোগীর সংখ্যা বেড়ে চলছে। চলমান শৈত্যপ্রবাহে আক্রান্তের সংখ্যা আরও বেড়েছে। বেশীরভাগ শিশু নিউমোনিয়া ও শ্বাসকষ্টে ভুগছে। চিকিৎসা দিতে তারা হিমশিম খাচ্ছেন। একটি শয্যায় দুইজন করে শিশু রোগী রেখেও তারা পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছেন না।

ওয়ার্ডের ভর্তি রেজিষ্ট্রারের তথ্য সুত্রে সেবিকা নাসরিন বেগম জানালেন, গত বৃহস্পতিবার ১২০জন, শুক্রবার ১৩৮ জন শনিবার ও রোববার ১২৭ জন করে রোগী ভর্তি ছিল শিশু ওয়ার্ডে। গত ৩দিনে ৩টি শিশুর মৃত্যু হয়েছে এই ওয়ার্ডে।

রোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখানে কাড়াকাড়ি শুধু শয্যা সংকট নিয়েই হয়না, চিকিৎসা সরঞ্জামও অপ্রতুল। পুরো ওয়ার্ডের জন্য মাত্র একটি নেবুলাইজার (শ্বাসকষ্ট রোগীর গ্যাস প্রদানে ব্যবহৃত)। সেটি নিয়েও কাড়াকাড়ি হওয়ায় রোগীর স্বজনদের মধ্যে। স্বচ্ছলরা বাহির থেকে নেবুলাইজার কিনে নিয়েছেন। অক্সিজেন পরিমাপের জন্য একমাত্র ‘অক্সিমিটারটি’ পুরোপুরি বিকল।

পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার মহিপুরের মো. জাকির হোসেন জানান, ওষুধের মূল্য ১০০ টাকার মধ্যে থাকলে সেটা হাসপাতাল থেকে দেয়া হয়। মূল্য এর চেয়ে বেশী হলে বাহির থেকে কেনার জন্য নার্সরা স্লিপ ধরিয়ে দেন। দেড়মাস বয়সী সন্তান রহমতউল্লাহ ঠান্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত হলে তাকে নিয়ে ৬দিন আগে হাসপাতালে আছেন জকির হোসেন।

১০ মাসের সন্তান আলিফাকে নিয়ে ৮দিন শিশু ওয়ার্ডে ছিলেন বরগুনা সদর উপজেলার লাইলী বেগম। সন্তানকে নিয়ে গতকাল বেলা ৩টার দিকে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হন। তিনি জানালেন, এক বুয়াকে ১০০ টাকা ঘুষ দিয়ে একটি শয্যা পেয়েছিলেন। ওই বুয়াকে প্রতিদিন শয্যাভাড়া দিতে হয়েছে ৫০ টাকা করে।

নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত ১০ মাস বয়সী সন্তান তুর্য্য দত্তকে নিয়ে ৪দিন যাবত শিশু ওয়ার্ডের মেঝেতে আছেন নলছিটি উপজেলার ষাটপাকিয়া গ্রামের প্রিয়াংকা মাঝি। তিনি জানালেন, সকাল ও বিকালে সিনিয়র চিকিৎসকরা ওয়ার্ড পরিদর্শনে গেলে মেঝের রোগীদের ওঠিয়ে প্রতি শয্যায় দুইজন করে রাখা হয়। চিকিৎসকরা চলে যাওয়ার আবার তাদের মেঝেতে নামানো হয়।

শিশু ওয়ার্ডের সাবির্ক পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে শেবাচিম হাসপাতালের পরিচালক ডা. সাইফুল ইসলাম বলেন, শীতের তীব্রতা বেড়ে যাওয়ায় মেডিসিন ও শিশু ওয়ার্ডে রোগী বেড়েছে। তবে শিশু ওয়ার্ডে রোগীর চাপ অনেক বেশি। তারা সবাই ঠান্ডাজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত। আপাতত প্রতি শয্যায় দুজন করে রোগী রাখার জন্য বলা হয়েছে। শিশু ওয়ার্ডে রোগীর চাপ সামলাতে জরুরীভাবে ১০০ শয্যা স্থাপনের কাজ চলছে। অক্সিমিটার বিকল ও নেবুলাইজার সংকটের বিষয়টি শিশু ওয়ার্ডের দায়িত্বরতরা তাকে জানাননি। হাসপাতালের মজুদে পর্যান্ত নেবুলাইজার রয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *