‘আমি ভাগ্যবান, করোনা রোগীদের সেবা করতে পারছি’ – ডা. মশিউর

Spread the love

করোনাভাইরাস সংক্রমিত কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসা দিতে স্বেচ্ছায় নারায়াণগঞ্জে বদলি হয়ে এসেছেন ডা. মশিউর রহমান। সেখানে করোনা রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিতে পেরে তিনি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছেন।
সাহসী এই চিকিৎসক মুঠোফোনে একটি গণমাধ্যমকে দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দেন। সেখানে উঠে আসে তার মহৎ এই কাজের অভিজ্ঞতার কথা।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অন্নদা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি শেষ করে ভর্তি হন নটরডেম কলেজে। সেখানে এইচএসসি শেষ করে খুলনা মেডিকেল কলেজে পড়াশোনা করেন। এরপর ৩৯তম বিসিএস‘র মাধ্যমে গত ডিসেম্বরে চাকরিজীবন শুরু।
পাঁচ মাসের চাকরিজীবনে ডা. মশিউর রহমান একটি সাহসী উদ্যোগ নিয়েছেন। অনেক চিকিৎসক যেখানে করোনা রোগীদের চিকিৎসা দিতে চাচ্ছেন না, সেখানে স্বেচ্ছায় রোগীদের সেবা দিতে এসে একটি নজির স্থাপন করেছেন তিনি।
ডা. মশিউর রহমান সহকারী সার্জন হিসেবে কর্মরত ছিলেন সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার দেবিল (মাগুড়া বিনোদ) ইউনিয়ন উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্রে। সেখান থেকে গত ১৪ এপ্রিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে নিজের বদলির আবেদন করেন তিনি। সেই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৭ এপ্রিল তাকে নারায়ণগঞ্জের ৩০০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে সংযুক্ত করা হয়। সেখানে তিনি গত ৩০ এপ্রিল কাজে যোগদান করেন। এখন সেখানে করোনা রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন তিনি।
ডা. মশিউর রহমান বলেন, ‘নতুন একটা জায়গায় জয়েন করেছি। এটা তো করোনা ইউনিট, এখানে সতর্ক থাকতে হচ্ছে। আমরা থাকছি নারায়ণগঞ্জ ক্লাবে। সেখান থেকে হাসপাতালে আসার জন্য দুটা গাড়ির ব্যবস্থা করা হয়েছে। এখানে আমাদের খাবার ভালোমতো দেওয়া হচ্ছে। আমাদের এখানে কোনো সমস্যা নেই।’
হাসপাতালের আইসোলেশন ইউনিটে রোগী সম্পর্কে এই চিকিৎসক বলেন, ‘আইসোলেশন ইউনিট চালুর পর এখানে গত মঙ্গলবার পর্যন্ত ৭১ জন রোগী ভর্তি ছিল। এ ছাড়া প্রতিদিন আমরা এখানে অন্তত ৭০ জন রোগী দেখি, যাদের লক্ষণ ওভাবে নেই, তাদের আমরা প্রাইমারি চিকিৎসা দেই, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করি, কাউন্সেলিং করি। সবকিছু আমাদের করা লাগে। আমি যোগদান করার পর এখানে কোনো করোনা রোগী মারা যায়নি।’

পর্যাপ্ত প্রটেকটিভ ইকুইপমেন্ট (পিপিই) বা ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী পাচ্ছেন জানিয়ে এই সাহসী চিকিৎসক বলেন, ‘এখানে পর্যাপ্ত পিপিই আমি পাইছি। ইউরোপ-আমেরিকার সঙ্গে তো তুলনা দিলে হবে না। এখানে আমরা মানসিকভাবে সন্তুষ্ট। এরপরও কিছু প্রতিকূলতা আছে। যেমন জরুরি বিভাগে দুটা গ্লাস লাগানো দরকার। এটা আমরা বলেছি কর্তৃপক্ষকে, যাতে রোগীরা গ্লাসের ওপারে থাকে। এখন গ্লাস নেই, তাই দূরত্ব মেনে চলি।’

করোনা রোগীদের সেবা দেওয়া প্রসঙ্গে ডা. মশিউর রহমান বলেন, ‘করোনা রোগী দেখে আমার চোখ দিয়ে পানিও আসে। কারণ রোগীরা অসহায়, তাদের সঙ্গে কেউ নেই আমরা ছাড়া। রোগীদের বলতে গেলে বন্দিজীবন। তাদের আত্মীয়-স্বজনরা সবাই দূরে। কেউ তাদের দেখতেও আসে না। এটা মানবিক দিক। আমি খুবই আনন্দিত যে, আল্লাহ আমায় এই সুযোগটা দিয়েছেন রোগীদের সেবা করার।’

মশিউর রহমান আরও বলেন, ‘করোনা রোগীদের চিকিৎসার অভিজ্ঞতা তিক্তই বলা যায়, কেননা যখন খারাপ রোগী দেখি, চোখের সামনে একজনের শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, বুকেব্যথা হচ্ছে, তখন খুব খারাপ লাগে। তখন আমরা চাই, যদি এসব রোগীর কষ্ট কিছু করতে পারি। এ জন্য সব সময় আমরা চেষ্টা করছি।’

এই চিকিৎসক আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের অনেক চিকিৎসক যারা করোনা ইউনিটে নেই, তারা তো আসলে এই ধরনের রোগীও দেখে না। এ ক্ষেত্রে আমি আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করি। বাংলাদেশ সরকারের কাছেও আমি কৃতজ্ঞ যে, আমায় করোনা রোগীদের সেবা করার সুযোগ দিয়েছে। আমি এ জন্য নিজের কাছে গর্ববোধ করি, আমি ভাগ্যবান যে করোনা রোগীদের সেবা দিতে পারছি।’

করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার সাহস পেলেন কীভাবে, উত্তরে ডা. মশিউর বলেন, ‘আমার নানা বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। আমি তার কাছে অনেক সাহসের গল্প শুনতাম। করোনা পরিস্থিতিতে আমি প্রতিদিনের খবর দেখতাম, দিন দিন সংখ্যাটা বেড়ে যাচ্ছিল দেখে আমি ভাবলাম, যদি আমার অবস্থান থেকে এই করোনা রোগীদের জন্য কিছু করতে পারতাম।’

এই চিকিৎসক বলেন, ‘ভয়ভীতি তো আছে, এরপরও আমার কাছে মনে হতো যে, এখানে আক্রান্ত হলেও আল্লাহর কাছে এর একটা পুরস্কার আছে। আল্লাহ চাইলে তো আমায় হেফাজতও করতে পারেন, যদি আমি সেভাবে নিজেকে নিরাপদ রাখি। আর একটা বিষয় ভাবতাম, কেউ না কেউ তো এগিয়ে আসতে হবে। এদের যদি আমরা চিকিৎসাসেবা না দেই, তাহলে তো তারা মারা যাবে। এ বিষয়টি আমার কাছে হৃদয়বিদারক মনে হতো। ভাবতাম রোগীরা তো আমার আত্মীয়-প্রতিবেশী বা ভাইবোন-এটা একটা অনুপ্রেরণা ছিল। আর দ্বিতীয়ত আমি করোনা বিষয়ে ট্রেনিং করেছি। বিষয়টি আমি ভালোভাবে শিখেছি। এটা প্রয়োগ করার একটা সুযোগ খুঁজতাম। তাই এই আবেদন করা।’

এমন সাহসী উদ্যোগ নতুন চিকিৎসকদের অনুপ্রেরণা দেবে জানিয়ে ডা. মশিউর বলেন, ‘বাংলাদেশে আমি প্রথম এভাবে আবেদন করেছি, এর আগে কেউ করেনি। বিশেষ করে ২০ হাজার নতুন ডাক্তার নিয়োগ হবে। তাদের জন্য অনুকরণীয় যে, তারা সাহস করে করোনা রোগী যেন দেখে।’

বদলির আবেদনে যা লিখেছিলেন ডা. মশিউর রহমান

দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ জেলায় করোনা রোগীদের সেবাদানের জন্য আইসোলেশন সেন্টার এবং করোনা নিবেদিত হাসপাতাল সমূহে সরকারি ডাক্তারদের স্বল্পতা দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় আমি ঢাকা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ জেলায় করোনা টিমে বদলি হয়ে করোনা রোগীদের সেবা করতে ইচ্ছুক। তাই আমাকে ঢাকা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ জেলার যেকোনো করোনা রোগীদের স্বেচ্ছাসেবা কেন্দ্রে বদলি করে করোনা রোগীদের সেবা করার সুযোগ দানে হুজুরের সদয় মর্জি হয়।

আমার নানা বীর উত্তম সুবেদার হাবিবুর রহমান ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব। বিজিবি পিলখানা সদর দপ্তরের ঢাকা নিউ মার্কেট সংলগ্ন ৩ নম্বর গেটের নাম বীর উত্তর হাবিবুর রহমান গেট। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি নিজের জীবন বাজি রেখে অংশগ্রহণ করেছিলেন। দীর্ঘ ৪৬ বছর তিনি পঙ্গু অবস্থায় থেকে ২০১৭ সালে মৃত্যুবরণ করেন। নানার আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে আমিও করোনা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে চাই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *