মা দিবস ও প্রবাসী সন্তান

Spread the love

সৈয়দ জুয়েল, আয়ারল্যান্ড থেকে: জোয়ান হেরিস লিখেছিলেন- সন্তানেরা ধাঁরালো চাকুর মত, তারা না চাইলেও মায়েদের কস্ট দেয়, আর মায়েরা তাদের শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে পর্যন্ত সন্তানদের সাথে লেগে থাকে। এর মানে এই নয় যে সন্তানদের ব্যাবহার মা কে কস্ট দেয়। কস্টের সড়কের কতগুলো বাঁক থাকে, কথা হলো আমরা কে কোন বাঁকে ফেলে মা কে কস্ট দিয়েছি।
দেশ ছেড়ে যেদিন প্রবাসের উদ্দেশ্যে যাত্রার প্রাক্কালে মায়ের মুখটির কথা মনে পরে? আত্বীয় স্বজনের চোখের জলের ভাষা,আর মায়ের চোখের জলের ভাষার ভিতর কোন পার্থাক্য দেখেছিলেন? সন্তান তোমাকে জন্ম দিতে গিয়ে আমি দশটি মাস ঠিক ভাবে ঘুমোতে পারিনি, নিদ্রাহীন চোখের নীচে কালি, স্বাভাবিক চলাফেরায় প্রতিবন্ধকতা আর খাবার না খেতে পারার কস্টকে ভূলে ছিলাম তোমার অস্তিত্ব টের পেয়ে। যে হাসি মুখটি দেখার জন্য আমি আমার জীবনকে তুচ্ছ মনে করেছিলাম, ছোটবেলায় যে খোকা আমাকে ছাড়া ঘুমোতেও যেতে ভয় পেত, রাতে ঘুম ভেঙ্গে পাশে না দেখলে কান্না করে অবাক নয়নে তাকিয়ে থাকতো,আমার উপস্থিতিতে তোর সে তৃপ্তির হাসি।
আজ থেকে সে হাসি মুখটি আর দেখতে পারবোনা! আজ তুমি আমায় ছেড়ে চলে যাও? হয়তো এটিই ছিল মায়ের না বলা কথার ভাষা। জীবন ও জীবিকার তাগিদে প্রবাসে যে সব সন্তানরা থাকেন,মায়ের আঁচলের মিস্টি গন্ধটা তাদের তাড়িয়ে বেড়ায় ব্যাস্ততার জানালার চারিধারে। তথ্য প্রযুক্তির আধুনিকায়নে ফেসবুকে স্টাটাস অথবা ভিডিও কলে মা দিবসে অনেকেই মাকে শুভেচ্ছা যানান, কিন্তু ঐ আঁচলের ঘ্রানের শূন্যতার বিষন্নতায় আটকে যায় প্রবাসের প্রতিটি দিন। পৃথিবীতে অনেক সফল ও শীর্ষ ধনী আছেন, যাদের সফলতার গল্প শুনে যে সবচেয়ে গর্ববোধ করতো, সেই রতœ গর্ভা মা তাদের নেই। একিটি চাঁদর কিনে মায়ের গায়ে জড়িয়ে ধরে বলতে পারেনা- মা তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে!
উত্তরে পাগল ছেলে বলে কি!বলে মায়ের মুখের সেই পূর্ন আলোয় আলোকিত হতে না পারার গøানি তারাই উপলব্ধি করে, যাদের গৃহে মা নেই। একজন মা যার আছে, সে-ই পূর্ন ভাগ্যবান। যে ঘরে এই প্রদীপ আছে,তার যতœ নেয়ার সৌভাগ্য খুব বেশীদিনের থাকবেনা, যেদিন এ প্রদীপ নিভে যাবে-সেদিন হাজারো চেস্টায় এ প্রদীপ থেকে আর ভালবাসা, ত্যাগ, আর সুগন্ধি আঁচলের নীলাভ আলো বিচ্ছুরিত হবেনা।
সেদিন সন্তানদের বিরহ মনের সুপ্ত বাসনার আলিঙ্গন ডুকরে কেঁদে উঠে সমুদ্র শূন্যতায় ডুবে তরীর খোঁজে সাঁতার কাটবে জীবন চলার প্রতিটি বাঁকে। প্রবাসী সন্তানরা মাকে কাছে পান খুবই কম সময়ে। তিন চার বছর পর পর যারা দেশে যান, প্রতিবারই কিছু পরিবর্তন দেখা যায় মায়ের ভিতর। যে মায়ের চুলগুলো ঘন কালোয় পরিপূর্ন ছিল,সেখানে শুভ্র চুলের আবির্ভাব, এর আরো পরে যে মা সোজা হয়ে চলতো, বয়সের ভারে ন্যুয়ে পড়েছে শরীর, একটু সোজা হয়ে চলার জন্য হাতে সোভা পেল লাঠি। এভাবেই কখন যে মার বাক শক্তিও লোপ পেল প্রবাসী সন্তানরা টেরই পেলনা। যখন কূঁজো হয়ে লাঠি ভর করে,তখনও বিদেশ থেকে সন্তানের আগমনে মা সোজা হয়ে দাঁড়ানোর ব্যার্থ চেস্টা করে হাসি দিয়ে সন্তানের পাশে এসে জিগাসা করে- ‘কখন খেয়েছ? আয় খেয়ে নে।’
হয়তো কথাগুলোও ততটা সঠিক উচ্চারন করতে পারেন না। কারন দাঁতগুলোও যে আর নেই। দৃস্টি শক্তিও আর আগের মত নেই,তারপরও মুখে হাত দিয়ে বলতে পারে এ তার সন্তান। সন্তান আর মায়ের শরীরের আলাদা একটা ঘ্রান আছে, এটা শুধু এ দুজনেরই ভিতর সৃস্টিকর্তা দিয়েছেন, যা চোখে না দেখলেও সন্তান ও মা বুঝতে পারেন। এ ঘ্রানের এতই শক্তি হাজার হাজার মাইল দূরে থাকলেও সন্তান ও মা এই ঘ্রান নিয়েই বেঁচে থাকে। আর এ জন্যেই প্রবাসে যেমন সন্তান কস্টে থাকলে মা বুঝতে পারেন সবার আগে, ঠিক তেমনই সন্তানরাও বুঝতে পারেন- মার শরীরটা মনে হয় আজ ভালনা। আমরা প্রবাসের সন্তানরা মায়ের ওই মায়ার ঘ্রানটা নিয়েই বেঁচে থাকি। অপেক্ষার দিন যতই যায়,ততই ক্রমশঃ বাড়তে থাকে সে ঘ্রানের তীব্রতা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *