বরিশালের ওয়াপদা কলোনী : গণহত্যার নিরব স্বাক্ষী

Spread the love

পুলক চ্যাটাজি, অতিথি রিপোটার : ‘বাংকারে ঢুকে আমরা আতকে উঠি। বাংকারের মধ্যে আমরা কয়েকজন নারীর মৃতদেহ পাই। কয়েকজন অবশ্য তখনও জীবিত ছিল, তবে কারো শরীরে এক টুকরো কাপড়ও ছিলনা। আমরা তাদের উদ্ধার করে বিভিন্ন স্থানে পাঠিয়ে দেই। পুরো এলাকার সর্বত্র ধ্বংসযজ্ঞের চিহৃ ছড়িয়ে ছিল’। বরিশাল শত্রুমুক্ত হওয়ার বরিশাল তথা দক্ষিণাঞলের সবচেয়ে বড় গণহত্যা ও নির্যাতন কেন্দ্র ওয়াপদা কলোনীর চিত্র এভাবেই বর্ণনা করেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন মাহফুজ আলম বেগ। তিনিই প্রথম বাংকারে ঢুকেছিলেন।

গনহত্যায় ব্যবহৃত সাগরদী খালে ব্রীজটি এখন স্মৃতিস্তম্ভ ‘৭১’। সেখানে দাড়িয়ে আছেন লেখক পুলক চ্যাটাজি

ওয়াপদা কলোনীতে টানা ১৯ দিন পাকিস্তানী হানাদারদের টর্চার সেলে (নির্যাতন কেন্দ্র) বন্দী ছিলেন বরিশালের মুক্তিযোদ্ধা এএমজি কবীর ভুলু। সেখানে পাকিস্তানি বাহিনির গণহত্যা ও ভয়াবহ নির্যাতনের কথা বলতে গিয়ে তিনি এখনও ডুকরে কেঁদে ওঠেন। তিনি বলেন, ওয়াপদা কলোনীর একাধিক টর্চার সেলে বাঙ্গালী নারী-পুরুষদের ধরে নিয়ে সীমাহিন নির্যাতনের পর সাগরদী খালের একটি সেতুতে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হতো। অগনিত গণহত্যার নিরব স্বাক্ষী এই ওয়াপদা ক্যাম্প।
এএমজি কবীর ভুলু বলেন, গণহত্যার স্মারকগুলো সংরক্ষন করায় আগামী প্রজন্ম পাকিস্তানি হানাদার বাহিনির বর্বরতার ইতিহাস জানতে পারবে। গত ৮ ডিসেম্বর বরিশাল শত্রুমুক্ত হওয়ার দিনে (বরিশাল মুক্ত দিবসে) টর্চার সেল ও বধ্যভূুমি সংরক্ষন প্রকল্পের উদ্বোধন করেন বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ।

পাক হানাদাররা মুক্তিকামী বাঙ্গালীদের হত্যা করে ফেলে দিতে ছবির এই ব্যাংকারে


বরিশালের একাধিক বীর মুক্তিযোদ্ধার দেয়া তথ্যমতে, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনি বরিশালে আসে ২৫ এপ্রিল (১৯৭১) ওইদিন গানবোট ও হেলিকপ্টারে করে পাকিস্তানি বাহিনীর একাধিক দল স্টীমারঘাট, বিসিক ও চরবাড়িয়া এলাকা থেকে শহরে প্রবেশ করে। বরিশাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিপরীতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কলোনী দখল করে তাদের ক্যাম্প বানায়। ক্যাম্পের পশ্চিম দিকে সাগরদী খালের তীরে বাংকার তৈরী করে সসস্ত্র পাহাড়া দিতো পাকিস্তানি সেনারা।
বীর মুক্তিযোদ্ধা মহিউদ্দিন মানিক (বীর প্রতিক) বলেন, বরিশাল তথা গোটা দক্ষিণাঞ্চলে ওয়াপদা কলোনীর মতো এত বড় নির্যাতন ক্যাম্প ও বধ্যভূমি আর কোথাও ছিলনা। বরিশালের এই ক্যাম্প থেকেই ঝালকাঠী, পটুয়াখালী ও ভোলায় অপারেশন চালাতো পাকিস্তানি বাহিনী। ওয়াপদা ক্যাম্পে নিয়ে কত মানুষকে হত্যা ও নির্যাতন চালানো হয়েছে তার সুনির্দিষ্ট হিসাব নেই।
বরিশাল সিটি করপোরেশনের অর্থায়নে এবং মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক, বরিশাল মুক্তিযোদ্ধা সংসদ এবং বরিশাল সাংস্কৃতিক সংগঠন সমম্বয় পরিষদের সহযোগীতায় একটি প্রকল্পের মাধ্যমে সংরক্ষন করা হয়েছে পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতার স্মৃতিবহ এলাকা ওয়াপদা কলোনী। যারমধ্যে রয়েছে নির্যাতন ক্যাম্প, ব্যাংকার, বধ্যভূমি, সেতু ও লাশ ভাসিয়ে দেয়া সাগরদী খাল। শ্রদ্ধা জানানোর জন্য সেতুর ওপর নির্মান করা হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ ‘৭১’। দেড় একর জায়গার ওপর সংরক্ষিত পুরো প্রকল্পের সার্বিক নকশা প্রনয়ন করেছে ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক (ইউএপি)।

ওয়াপদা কলোনীর সংরক্ষন প্রকল্প দেখতে প্রতিদিনি বিকালে আসেন নতুন প্রজন্মের সন্তানরা


বরিশাল সিটি করপোরেশনের সহকারী প্রকৌশলী মকসুমুল হাকিম রেজা বলেন, প্রায় ৪ কোটি টাকা ব্যয়ে বধ্যভূমি সংরক্ষন প্রকল্পের আওতায় নির্মান করা হয়েছে ওয়াকওয়ে, স্মৃতিস্তম্ভ, বসার স্থান, প্লাজা, স্বজনদের স্মৃতি কথার গ্যালারি এবং নির্যাতনের আবহ সৃষ্টিকারী সাউন্ড সিস্টেম। সংরক্ষন করা হয়েছে দুটি টর্চার সেল ও একটি বাংকার।
নকশা প্রনয়নকারী ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের স্থাপত্য বিভাগের অধ্যাপক সাইদ আহমেদ বলেন, পাকিস্তানি বাহিনির নির্মিত বাংকার শুধু বরিশালেই আছে। একটি বাংকার সহ দুটি টর্চার সেল ও সাগরদী খালের ওপর যে ব্রীজটির ওপর নিয়ে গণহত্যা চালানো হতো সেটি সংরক্ষন করা হয়েছে। স্মৃতি করিডোরে স্বজনদের বেদনার্ত বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে এবং সাউন্ড সিস্টেমের মাধ্যমে দর্শনার্থীরা যাতে নির্যাতন-গণহত্যার ভয়াল আবহটা উপলব্দী করতে পারেন তার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাষ্টি বীর মুক্তিযোদ্ধা মফিদুল হক বলেন, ওয়াপদা কলোনী বড় নির্যাতন ও গণহত্যা কেন্দ্র। বরিশালের সাবেক মেয়র প্রয়াত শওকত হোসেন হিরণ মুক্তিযুদ্ধের এই স্মৃতিচিহৃ সংরক্ষনের উদ্যেগ নিয়েছিলেন ২০১২ সালে। তার মৃত্যুর পর সেই উদ্যেগে ভাটা পড়ে। বর্তমান মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ ব্যক্তিগতভাবে উদ্যেগ নিয়ে নির্যাতন কেন্দ্র ও গণহত্যার স্থানটি সংরক্ষন করেছেন। যার মাধ্যমে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়কার একটা বড় নৃশংসতার ইতিহাস সংরক্ষিত হয়েছে। এখনও কিছু কাজ বাকি আছে। এই স্থান থেকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আহরন করবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম।

ওয়াপদা কলোনী সংরক্ষন প্রকল্পে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্বজনদের ধারাভাষ্য দেখছেন লেখক পুলক চ্যাটাজি, পাশে হলুদ ভবনটিতে মুক্তকামী বাঙ্গালীদের আটেকে রেখে নির্যাতন করা হতো।


বরিশালের অন্যতম সংস্কৃতজন সৈয়দ দুলাল বলেন, পাকিস্তানি বাহিনির নৃশংসতার বড় স্থাপনা ওয়াপদা কলোনীর ধ্বংসের উপক্রম হয়েছিল। মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ সেটি সংরক্ষণ করে মহান মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ন স্থাপনা রক্ষা করেছেন। নতুন প্রজন্মকে পাকিস্তানিদের বর্বরতা জানাতে এখানে আসতে উৎসাহিত করতে হবে।
বরিশাল সিটি মেয়র ও মহানগর আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ বলেন, বরিশাল শহরেই জন্মেছি আমি। আমার শহরেই বিলুপ্ত হতে যাচ্ছিল স্বাধীনতার গৌরবের ইতিহাস ওয়াপদা কলোনীর টর্চারসেল ও বধ্যভূমি। মেয়র নিযুক্ত হওয়ার পরে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের রাজস্বাক্ষী বধ্যভূমি ও টর্চারসেল সংরক্ষনের উদ্যেগ গ্রহন করি। বরিশালের এ নির্যাতন কেন্দ্র ও বধ্যভূমি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের জন্য বিশেষ এক ভূমিকা পালন করবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানাতে। তাদের হৃদয়ে দেশত্মবোধ জাগ্রত করবে। শ্রদ্ধা আর ভালবাসায় আজীবন স্মরন করবে মহান মুক্তিযোদ্ধাদের।##

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *