সংগ্রামী মায়ের সোনালী ফসল চিকিৎসক মেয়ে

Spread the love

নাগরিক রিপোর্ট  :  বছরের শুরুর দিকে ডা. শামীমা নাজবীন অপু (২৬) মুঠোফোনে একটি কল আসে। রিসিভ করার অপরপ্রান্ত থেকে কথা বলেন তার এক ভাই। বৈমাত্রের (সৎ) ভাই তিনি। এক শহরে বাস করেও স্বচ্ছল এই ভাই কিম্বা তাদের পরিবারের সঙ্গে দীর্ঘবছর যোগাযোগ ছিলনা দর্জিকন্যা অপুর। এখন তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ হচ্ছে অপুর। আরও অনেকে এখন যোগাযোগ রাখেন, যারা আগে অপুর পরিবারকে এড়িয়ে চলতো। কারন দর্জিকন্যা পরিচয় ছাপিয়ে সমাজে অপুর পরিচয় এখন একজন চিকিৎসক।
নোয়াখালীর সরকারি আবদুল মালেক উকিল চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় থেকে ২০১৮ সালে এম.বি.বি.এস পাশ করেছেন তিনি। বরিশাল সিটি করপোরেশন পরিচালিত নগর স্বাস্থ্য কেন্দ্রে চাকুরী করছেন। কুড়েঘর ছেড়ে মায়ের সঙ্গে নগরের ২৮ নম্বর ওয়ার্ডে কাশীপুর বাজার সংলগ্ন একটি ফ্লাটে ভাড়া থাকেন।
অপুর চিকিৎসক পরিচয়ের নেপথ্যে রয়েছে এক সংগ্রামী মায়ের গল্প। যিনি প্রায় সারাটা জীবনই দর্জি কাজের পাশাপাশি বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার দর্জি শিক্ষা প্রকল্পেও কাজ করেছেন। এখনও করছেন।
শাহনাজ পারভীন (৫৮) নামক এই মায়ের ২২ বছর সংগ্রামী জীবনের সোনালী ফসল ডা. শামীমা নাজবীন অপু। সতীনের সংসারে পারিবারিক অশান্তির জেরে ১৯৯৮ সালে স্বামী বীর মুক্তিযোদ্ধা নজরুল ইসলামের সংসার ত্যাগ করেন শাহনাজ পারভীন। তখন একমাত্র সন্তান অপুর বয়স ৫ বছর। নজরুল ইসলাম ২০১১ সালে ইন্তেকাল করেছেন।
শাহনাজ পারভীন জানান, স্বামীর সংসার ছাড়ার পর একটাই স্বপ্ন ছিল মেয়েটাকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করা। পিতার পরিবারে স্বচ্ছলতা না থাকায় দর্জি কাজের পাশাপাশি এনজিওতে কাজ করেছি। শাহনাজ বলেন, মেয়েকে মেডিকেল কলেজে ভর্তি করার পর বিভিন্ন সমযে ভাই-বোনসহ আত্মীয় স্বজনদের কাছ থেকে ঋন হিসাবে আর্থিক সহযোগীতা পেয়েছি।
মেয়ে এখন চিকিৎসক- স্বপ্ন পুরন হয়েছে জানতে চাইলে শাহনাজ পারভীন একটি নি:শ^াস ছেড়ে বলেন, ‘মেয়েডারে ডাক্তারী পড়াইতে এখনও প্রায় ১৫ লাখ টাকা ঋনী। সোনালী ব্যাংকেই পাইবে ৩ লাখ ১০ হাজার টাকা। ২০১২ সালে মেডিকেল কলেজে ভর্তি করার পর ব্যাংক থেকে ৪ লাখ টাকা ঋন নেছেলাম। ওই ঋন এখনো টানছি’।
পেছনের কথা বলতে গিয়ে শাহনাজ পারভীন জানান, ডিগ্রীর ছাত্রী ছিলেন তিনি। তখন পরিচয় হয় নগরের বিউটি সিনেমা হল সংলগ্ন ওয়ার্কশপ ব্যবসায়ী নজরুল ইসলামের সঙ্গে। এক পর্যায়ে হয় প্রেমের সম্পর্ক। ১৯৮৯ সালে বিয়ে হয় তাদের। বিয়ের পর জানতে পারেন নজরুল ইসলামের আগের স্ত্রী ও সন্তান রয়েছে।
ফলে যা হবার তাই হয়েছে। আগের স্ত্রী ও পরিবার এ বিয়ে মেনে নেয়নি।
বিভিন্ন জায়গায় ভাড়া বাসায় থেকেও শেষ পর্যন্ত সংসার টেকাতে পারেননি পারভীন। কাগজপত্রে বিচ্ছেদ না হলেও ১৯৯৮ সালে স্বামীর সংসার ত্যাগ করেন শাহনাজ। তার আগে ‘৯৩ সালে জন্ম হয় একমাত্র কন্যাসন্তান অপুর।
তিনি বলেন, স্বামীকে খুশি রাখার জন্য ‘৯৬ সালে ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স স্কুলের সহকারী শিক্ষক পদের চাকুরী ত্যাগ করে বরিশালে চলে আসেন। ওই চাকুরীটা থাকলেও তার জীবনটা অন্যরকম হতে পারতো।
শাহনাজ বলেন, দরিদ্র পিতার সংসারে স্বচ্ছলতা আনতে স্কুলজীবনে সেলাই কাজ শিখেছিলাম। পরবর্তীতে এটাই হয় বেঁচে থাকার অবলম্বন। ‘৯৭ সালে ১৫০০ টাকা ঋন নিয়ে একটি সেলাই মেশিন কিনে দর্জির শুরু করেন। ২০০৩ সালে ৩০ হাজার টাকা ঋন নিয়ে ব্যবসা সম্প্রসারন করেন। কাশীপুর বাজারে শাহনাজ টেইলার্স অ্যান্ড ক্লোথ ষ্টোর্স নামক একটি দোকান পরিচালনা করেছেন। তার কাছে কাজ শিখে স্বাবলম্বী হয়েছেন শতাধিক নারী।
এদের মধ্যেই এক নারীর কাছে চীর ঋনি জানিয়ে শাহনাজ বললেন, মেয়ে মেডিকেল কলেজে সুযোগ পাওয়ার পর ভর্তি করানোর মতো টাকা ছিলনা তার। তার কাছে শিখতে আসা এক নারী স্বর্ণলংকার বন্ধক রেখে ৩০ হাজার টাকা দিয়েছিলেন তাকে। ওই টাকাটা না পেলে মেয়েটা আজ ডাক্তারহতো পারতো না। ##

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *