ইডেনে ভাইরাল নেত্রীদের যত কীর্তি

Spread the love
নাগরিক ডেস্ক : কেউ সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিবস্ত্র করার হুমকি দিয়ে, কেউ গায়ে গরম চা ঢেলে, আবার কেউ সহপাঠীকে পিটিয়ে ভাইরাল হয়েছেন। সামাজিক মাধ্যমসহ সবখানে আলোচনা ও সমালোচনার কেন্দ্রে তারা। তাদের বেপরোয়া আচরণের শিকার সতীর্থ-সংগঠনের সহকর্মী সবাই। এহেন কর্মকাণ্ড ঐতিহ্যবাহী ইডেন মহিলা কলেজ ছাত্রলীগের কতিপয় নেত্রীর। সংগঠনটির অর্ধডজন নেত্রী নানা বিশৃঙ্খল ও উগ্র কর্মকাণ্ডের কারণে সমালোচিত। সম্প্রতি গণমাধ্যমের সামনেই তাদের চুলাচুলি, হাতাহাতির ঘটনাও রীতিমতো আলোচনার জন্ম দিয়েছে। তাদের রোষানলে পড়া সাধারণ শিক্ষার্থীরা বলছেন, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের কড়া কমান্ড না থাকা ও কলেজ প্রশাসনের নীরব ভূমিকার কারণে যাচ্ছেতাই করছেন এ নেত্রীরা।
ইডেনের ‘ডন’ তামান্না জেসমিন রিভা
ইডেন মহিলা কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি তিনি। সম্প্রতি নানা বিতর্কিত ঘটনায় কলেজ ছাত্রলীগের ডন নামে খ্যাতি পেয়েছেন রিভা। মাসখানেক আগে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে তার এক অডিও। ‘ইডেন কলেজের প্রেসিডেন্টের ওপরে আর কেউ নাই। আমি যদি একটা সিট না দিই, ২০২ থেকে তোদের কোন বাপ সিট দেবে? ম্যাডামরা দেবে? ক্ষমতা আছে ম্যাডামদের?’ অডিওতে এ কথা বলতে শোনা যায় রিভাকে। শুধু তা-ই নয়, তার রুমে ডেকে নিয়ে দুই ছাত্রীকে বিবস্ত্র করে ফেসবুকে ছেড়ে দেওয়ার হুমকি দেন তিনি। গণমাধ্যমে এ নিয়ে সংবাদ প্রকাশ হওয়ার পর তামান্না জেসমিন নিজ সংগঠনের নেতাদের কাছে দুঃখও প্রকাশ করেছিলেন।
ইডেন ছাত্রলীগ নেত্রীদের একাংশের অভিযোগ, কলেজের সরকারি হলের কক্ষ দখল করে ভাড়া দিচ্ছেন রিভা। কলেজের ছয়টি হলের ৩৮টি কক্ষ বর্তমানে রিভার দখলে। শুধু সিট ভাড়া থেকে রিভার মাসিক আয় পাঁচ লাখ ৭৬ হাজার টাকা। তামান্না জেসমিন ইডেন কলেজের মার্কেটিং বিভাগের ২০০৯-১০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। কলেজ ছাত্রলীগের নেত্রীরা জানিয়েছেন, শুরু থেকেই এক যুগ ধরে তামান্না ছাত্রীনিবাসে থাকেন। এখন থাকেন কলেজের বঙ্গমাতা ছাত্রীনিবাসের ১১০৭ নম্বর কক্ষে।
সিট বাণিজ্যের ভাগিদার রাজিয়া সুলতানা
কলেজটিতে ছাত্রলীগের দুটি মূল গ্রুপ রয়েছে। একটির নেতৃত্বে রয়েছেন সভাপতি রিভা। অন্যটির নেতৃত্ব দেন সাধারণ সম্পাদক রাজিয়া সুলতানা। তিনি কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয়ের অনুসারী। তার বিরুদ্ধেও আছে সিট বাণিজ্যের অভিযোগ। কলেজ ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সামিয়া আক্তার বৈশাখী বলেন, ‘রাজিয়া কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি তিলোত্তমা সিকদারকে ম্যানেজ করে এ বাণিজ্য করে থাকেন। সভাপতির সঙ্গে মিলেই রাজিয়া সুলতানা সব কাজ করে থাকেন। তিনি লিয়াজোঁ মেনটেইন করে চলেন।’
চা ঢেলে দেন আয়শা ইসলাম মীম
ইডেন মহিলা কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি আয়শা ইসলাম মীম। এক আবাসিক শিক্ষার্থীর শরীরে গরম চা ঢেলে ও হাতে মোচড় দিয়ে নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে মীমের বিরুদ্ধে। গত ১৯ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় এ ঘটনা ঘটে। ঘটনাটি মুহূর্তেই ভাইরাল হয়। তিনি কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি তামান্না জেসমিন রিভার অনুসারী বলে জানা গেছে। অভিযোগ আছে, অন্য একটি মহিলা কলেজের অবৈধ কয়েকজন ছাত্রী মীমের ছত্রচ্ছায়ায় ইডেনের ছাত্রীনিবাসে থাকেন।
ভুক্তভোগী ঐশী বলেন, ‘সন্ধ্যায় আমি চা পান করছিলাম। মীম আপু আমার রুমে এসে গায়ের ওপর গরম চা ঢেলে দিয়ে রুমের সবাইকে বের হয়ে যেতে বলেন। আমি ভয় পেয়ে কাউকে বের হতে দিইনি। পরে তিনি আমার হাত ধরে মোচড় দেন। এতে আমার হাত মচকে যায়। মীম অনেক উগ্র মেজাজের। তিনি প্রায়ই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এ ধরনের খারাপ আচরণ করেন।’ তবে মীম বলেন, ‘গরম চা ঢেলে দেওয়ার মতো কিছু হয়নি।’
সাংবাদিককে গালি বিবাহিত সুস্মিতা বাড়ৈর
অভিযোগ ওঠে, বিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও ইডেন মহিলা কলেজে ছাত্রলীগের নবগঠিত কমিটিতে পদ পেয়েছেন সুস্মিতা বাড়ৈ। এ বিষয়ে জানতে চাইলে এক সাংবাদিককে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেন তিনি। গেল ১৩ মে তার সঙ্গে ওই সাংবাদিকের একটি কল রেকর্ড সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এর জের ধরে ফেসবুকে ক্ষমা চেয়েছেন ছাত্রলীগের এ নেত্রী। দুঃখ প্রকাশ করে সুস্মিতা বলেন, ‘তখন আমার কমিটির প্রেসারে মানসিক অবস্থা ভালো ছিল না। আমি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলাম। যে কারণে সাংবাদিক ভাইয়ের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে ফেলেছি, তাই ক্ষমাপ্রার্থী।’ জানা যায়, ২০১৮ সালের ১ জুলাই চিরঞ্জিৎ রায় নামে এক ব্যক্তিকে বিয়ে করেন সুস্মিতা।
প্রায় একই ঘটনা ঘটে এক নম্বর সহ-সভাপতি সোনালি আক্তারকে নিয়ে। অভিযোগ ওঠে-তিনি বিবাহিত। তার নাম-পরিচয়সহ একটি কাবিননামা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। কমিটিতে জায়গা পাওয়া ও না-পাওয়া কয়েকজন নেত্রীর দাবি, সোনালির বিয়ের বয়স ১৩ বছর। তবে বিয়ের বিষয়টি নিজেও অস্বীকার করেছেন সোনালি। জানিয়েছেন, বিষয়টি মিথ্যা।
সুন্দরীদের বাছাই করার অভিযোগ বৈশাখীর
গেল দুই দিন উত্তপ্ত ঘটনার মধ্যেই রিভা ও রাজিয়ার বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ তুলেছেন ইডেন কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সামিয়া আক্তার বৈশাখী। তিনি বলেন, ‘হলের বৈধ রুমের মেয়েরা উপস্থিতি খাতায় স্বাক্ষর করার সময় সভাপতি রিভার অনুসারীরা তাদের ছবি তুলে রাখেন। সেখান থেকে সুন্দরীদের বাছাই করেন। পরে বাছাই করা মেয়েদের রুমে নিয়ে বিভিন্ন ধরনের হুমকি দিয়ে খারাপ উদ্দেশ্যে তাদের বিভিন্ন ধরনের কুপ্রস্তাব দেওয়া হয়। কারণ তারা ওই মেয়েদের দিয়ে বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা করাতে চান। হঠাৎ এমন বিস্ফোরক বক্তব্য দেওয়ায় তিনি ভাইরাল হন। এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে সমালোচনা চলছে।’
আত্মহত্যার হুমকি জান্নাতুলের
ঘটনার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ইডেন কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি তামান্না জেসমিন রিভা ও সাধারণ সম্পাদক রাজিয়া সুলতানার বিচার করা না হলে আত্মহত্যার হুমকি দেন নির্যাতনের শিকার ইডেন কলেজ ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি জান্নাতুল ফেরদৌসী। সিট বাণিজ্য নিয়ে গণমাধ্যমে কথা বলায় মারধরের শিকার হয়েছেন বলে দাবি জান্নাতুলের। তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘আমাকে কক্ষে আটকে মারধর করা হয়েছে। আমার আপত্তিকর ছবিও তুলে রেখেছেন সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও তাদের সমর্থকরা।’ কথা বলার সময় তিনি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে যান।
এসব অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে চাইলে ইডেন কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে গতকাল ফোনে পাওয়া যায়নি। জানা গেছে, তারা অন্য গ্রুপের হামলায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তবে এসব ঘটনায় তারা ‘ষড়যন্ত্রের শিকার’ বলে তা উড়িয়ে দেন একাধিকবার। বারবার যোগাযোগ করলেও সাড়া দেননি কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য।
ইডেনে ঘা থেকে ক্যানসার : সোহান খান
ইডেন কলেজের পরিস্থিতি এখন এমন জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে, যা ঘা থেকে ক্যানসার হয়ে গেছে বলে মন্তব্য করেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সোহান খান। তিনি  বলেন, ‘ইডেনের ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। জয়-লেখকের উচিত ছিল সবাইকে নিয়ে বসে সমাধান করা। এটা না করে তারা উল্টো ভুক্তভোগীদের বহিষ্কার করলেন। কিন্তু হামলায় জড়িত ছিল দুটি গ্রুপই।’
আমাদের সময় এসব নোংরামি ছিল না : হেলেন জেরিন
সার্বিক বিষয়ে ইডেন কলেজ ছাত্রী সংসদের সাবেক ভিপি ও মহিলা দলের নেত্রী হেলেন জেরিন খান বলেন, ‘আমাদের সময়ে ইডেন কলেজে এমন নোংরামি ছিল না। এখন শুনি মেয়েদের নিয়ে ব্যবসা করা হয়। এসব কী শুনছি! আমাদের সময় কোনো সিট বাণিজ্য ছিল না। মেয়েদের মধ্যে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটার প্রশ্ন ওঠে না। পারস্পরিক সহাবস্থান ছিল তখন।’
আসলে ইডেনের ঘটনা ‘সিলি’ : অপু উকিল
তবে ছাত্রলীগের সাবেক নেত্রী ও যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক অপু উকিল  বলেন, ‘আসলে ইডেনের ঘটনা সিলি। আমরাও ছাত্র রাজনীতি করেছি। এমন মনোমালিন্য একসঙ্গে থাকতে গেলে হতেই পারে। পুরুষশাসিত সমাজে নারীদের ঘটনা অনেক বড় করে দেখা হয়। তবে নেত্রীদের সতর্ক হওয়া উচিত।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *