‘নিজেদের মৃত্যুর রাস্তা নিজেরাই তৈরি করেছি’

Spread the love

ইকবাল হোসেন তাপস: একজন সাহিনা বেগম আর একজন ডাক্তার আনোয়ার হোসেন আজ এক কাতারে। সাহিনা বেগম একজন অতি সাধারন গৃহবধূ ৭/৮ দিন যাবত সধারন জ্বরে ভুগছিলেন। হটাৎ করে শ্বাসকষ্ট অনুভব করছিলেন। স্বজনরা মিলে প্রথমে নারায়ণগঞ্জের একটি হাসপাতালে নেন। যেখানে তার স্থান না হওয়ায় নিয়ে যাওয়া হয় অন্য হাসপাতালে। সেখানেও তার স্থান হয়নি। সর্বশেষ নিয়ে যাওয়া হল ঢাকা মেডিকেলে। ততক্ষণে সাহিনা বেগম অক্সিজেনের অভাবে ফুসফুসের কর্ম ক্ষমতা প্রায় হারিয়ে ফেলেছেন। এমতবস্থায় ঢাকা মেডিকেল আর কি চিকিৎসা সেবা দিতে পারেন তা আমাদের সকলের জানা। সাহিনা বেগমের স্বজনদের অসহয় এর মতো তাকিয়ে দেখতে হল সাহিনার বাঁচার আকুতি। সাহিনা তার স্বজনদের অসহয় মুখ দেখতে দেখতে চলে গেলেন এই নিষ্ঠর পৃথিবী থেকে।

ডাঃ আনোয়ার হোসেনকে বরিশালে কে না চেনে, যিনি বরিশালের একজন স্বনামধন্য চিকিৎসক। ৮ জুন আনুমানিক সকাল ৮:৩০ বরিশাল থেকে বন্ধু ইদ্রিস মিয়া সবুজ ফোন করে বললেন, ডাঃ আনোয়ার অসুস্থ ঢাকায় নিতে হবে হেলিকপ্টার লাগবে। আমি সময় ক্ষেপণ না করে হেলিকপ্টার ভাড়া করার চেষ্টা করতে থাকলাম । সবার প্রশ্ন রোগী কভিড-১৯ আক্রান্ত কিনা এবং শেষ উত্তর “না”। অনেক চেষ্টার পরে একটা কোম্পানি রোগী নিজে ডাক্তার যেনে রাজি হলেন।
হেলিকপ্টার পাঠানোর সকল ব্যাবস্থা যখন সম্পন্ন ঠিক তখনই সিদ্ধান্ত বদল হল। বরিশাল থেকে বন্ধু নুরুল হক লস্কর জানালেন আনোয়ার ভাইর অবস্থা পূর্বের তুলনায় অনেকটা স্থিতিশীল। আপাতত ঢাকা নেওয়ার সিদ্ধান্ত স্থগিত করা হয়েছে এবং বরিশালের শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজের ডাক্তাররাই তার চিকিৎসা করবেন। খরটা শুনে কিছুটা হলেও সস্তি অনুভব করলাম।
আগের দিন রাতে জনাব আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ সাহেবের স্ত্রী সাহান আরা আবদুল্লাহ ইন্তেকাল করেছেন ইঝগগট হাসপাতালে। যিনি নিজে একজন মুক্তিযোদ্ধা, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর ফুপাত ভাইয়ের স্ত্রী, একজন মন্ত্রির স্ত্রী। যিনি বরিশালের বর্তমান মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহর মা । জানতে পারলাম মৃত্যুকালে তার দুই সন্তান মইন আবদুল্লাহ ও আশিক আবদুল্লাহ মরহুমার শয্যা পাশে উপস্থিত ছিলেন। মৃত্যুকালে তারা অনেক খোঁজাখুঁজি করেও কোন ডাক্তার তার মায়ের কাছে পাননি। ভাবতে অবাক লাগছে বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে বধূ যিনি ইন্তেকাল করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অথচ তার মৃত্যুকালে পাশে কোন ডাক্তার ছিলেন না।
ভাবলাম চিকিৎসার বর্তমান অবস্থা যদি এই হয় তাহলে ডা: আনোয়ার ভাইকে ঢাকায় এনেই বা কি লাভ। দুপুরের পরে যখন আনোয়ার ভাই’র খোঁজ নেওয়ার জন্য ফোন করলাম তখন জানতে পারলাম তাকে পুনুরায় ঢাকায় নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে এবং ঢাকার ঊাবৎপধৎব যড়ংঢ়রঃধষ (অঢ়ড়ষষড় ঐড়ংঢ়রঃধষ) এর সাথে কথা হয়েছে সেখানে ভর্তি করা হবে। খবরটা কিছুটা হলেও স্বস্তির ছিল কারন এই মাহামারিতে তারা ভর্তি নিতে সম্মতি দিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবতা ছিল অন্য, রোগী যখন ঢাকা আসলো তারা সাফ জানিয়ে দিল করোনা রোগী ভর্তি করার মতো খালি বেড তাদের নাই।
নেয়া হল আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালে সেখানেও ঠাই হল না এই করোনা যোদ্ধার। বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরতে ঘুরতে সব শেষ রাত ৯টার দিকে বাসাবোর একটি হাসপাতালে ঠাই হয় ডাঃ আনোয়ার হোসেনের। এতোক্ষণে ডাঃ আনোয়ার প্রায় হারিয়ে ফেলেছেন তার ফুসফুসের কর্ম ক্ষমতা। রাত আনুমানিক ২:৩০ মিনিটে চলে গেলেন না ফেরার দেশে।
এক জন ডাক্তার যিনি গত ৩০টি বৎসর মানুষের সেবা করে গিয়েছেন, যিনি বরিশালে সব চেয়ে আধুনিক হাসপাতালের মালিক, যিনি অসংখ্য মানুষ কে বিনা মূল্যে চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন- এই করোনা মহামারীতেও যিনি নিজেকে ও পরিবারকে ঝুঁকির মধ্যে রেখেও নিয়মিত তার চিকিৎসা সেবা চালিয়ে গেছেন। সেই চিকিৎসক কে আজ মৃত্যুবরন করতে হল হাসপাতালের দ্বারে দ্বারে ঘুরে অনাদরে, অবহেলায়। হায়রে হাসপাতাল, হায়রে চিকিৎসা ব্যাবস্থা, হায়রে প্রশাসন, হায়রে ডাক্তার, হায়রে মানুষ, হায়রে মানবতা।
একজন সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষনে ভর্তি আছেন, একটি বে-সরকারি হাসপাতালে। অথচ তার আমলে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যায় হয়েছে স্বাস্থ্য খাতে। একটি হাসপাতালও তৈরি করে যেতে পারলেন না যেখানে অন্তত তার নিজের চিকিৎসা করাতে পারেন।
বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অর্থপ্যাডিক সার্জন ডাঃ সুদীপ হালদার তার ফেসবুকে হাসপাতালের সামান্য দুরবস্থার কথা উল্লেখ করেছেন যা আজ আর নতুন কিছু নয়। নয় কোন গল্প বা খবর, সব আজ নির্মম বাস্তবতা। চিকিৎসা ব্যাবস্থা টা পুরাপুরি বেসরকারিদের হাতে জিম্মি হয়ে গেছে। যার কুফল আজকের মহামারীতে সকল বেসরকারি হাসপাতাল গুলো করোনা ভয়ে হাত গুটিয়ে বসে আছে।
আর এই নির্মম বাস্তবতার জন্য দায়ী সরকারে অব্যাবস্থাপনা, লাগামহীন দুর্নীতি, ডাক্তারদের অসহযোগীতা এবং ডাক্তারদের অতিমাত্রায় বাণিজ্যিক মানসিকতা। আজ নিশ্চয়ই ডাক্তার আমলা মন্ত্রী সবাই একমত হবেন স্বাস্থ্য খাত দুর্নীতি করা, অবহেলা করা ছিল নিজেদের মৃত্যুর পরওয়ানা নিজেদের হাতে তৈরি করার শামিল। তারা এতদিন ভেবে ছিলেন নিজেরা অসুস্থ হলে বিদেশে যাবেন। ডাক্তাররা ভেবেছিলেন নিজেরা অসুস্থ হলে অন্য ডাক্তার তাদের ভাল চিকিৎসা দিবেন, না হয় বিদেশে যাবেন। কিন্তু করোনা আজকে সবাইকে বুঝিয়ে দিলো এতদিন তারা দুর্নীতি, অবহেলা করে নিজেদের সর্বনাশ নিজেরাই করেছেন। একেই বলে প্রতিশোধ, প্রকৃতির প্রতিশোধ।
স্বাস্থ্য খাতকে সাজাতে চেয়েছিলেন প্রয়াত রাষ্ট্রপতি হুসাইন মোহাম্মাদ এরশাদ কিন্তু ডাক্তারদের অসহযোগিতার কারনে তিনি সফলকাম হন নাই বরং সেটা হয়ে ছিল তার ক্ষমতা হাত ছাড়া হওয়ার অন্যতম একটা কারন।
যেখানে শেরেবাংলা মেডিকেল গোটা বরিশালবাসির চিকিৎসার একমাত্র প্রধান ভরসাস্থল, সেখানে ২২৪ জন ডাক্তারের মধ্যে মাত্র ৯৫ জন ডাক্তার কর্মরত থাকবে কেন। এখানে দায়িত্বরত পরিচালক, স্থানীয় সাংসাদ, দায়িত্বপ্রাপ্ত জন প্রতিনিধিরা কি করছেন। এসব কিছু দেখার দায়িত্বও কি প্রধান মন্ত্রীর।
২০০৪ সালে সাবেক মেয়র শওকত হোসেন হিরন সঠিক সময় উপযুক্ত চিকিৎসা পেলে হয়ত বেঁচে যেতেন। যদি সেদিন বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিওরোসার্জন উপস্থিত থাকতেন, যদি হিরন সাহেবের মস্তিস্কে তাৎক্ষনিক অস্ত্রপাচার কারা যেত। পত্রিকার মাধ্যমে জানতে চেয়েছিলাম তৎকালীন নিউর সার্জন সেদিন কোথায়ে ছিলেন কেন তিনি হিরন সাহেব কে জরুরি অস্ত্রপচার করলেন না। কিন্তু আজ পর্যন্ত তার উত্তর জনগণের অজানা।
হয়ত খুব শিঘ্রই কোভিড-১৯ এর সঠিক চিকিৎসা বের হবে। আমরা আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবো। শুরু হবে আবার দুর্নীতি, ঘুষ, পুকুর চুরি, বালিশ চুরি, মিথ্যাচার, খাদ্যে ভেজাল, ঔষধে ভেজাল, হাসপাতালে দুর্নীতি সহ পুরান সকল অমানবিক রোগ গুলো। এই সকল রোগের যথা উপযুক্ত ঔষধ যতদিনে আবিস্কার না হবে ততদিনে আমাদের মুক্তি নাই আবার হয়তো আমরা আক্রাত হবো প্রকৃতির নতুন কোন আক্রোশে।
ইকবাল হোসেন তাপস- যুগ্ন মহাসচিব। জাতীয় পার্টি, কেন্দ্রীয় কমিটি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *