জামায়াত ছেড়ে আসা মনজু বললেন, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে

Spread the love

মজিবুর রহমান মনজু একসময় ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতা ছিলেন। গত ২ মে তাঁর উদ্যোগে আত্মপ্রকাশ করে নতুন রাজনৈতিক দল আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টি। তিনি দলের সদস্যসচিব। নতুন দল গঠনের আগে আদর্শ ও নীতির প্রশ্নে বিভিন্ন সময় দ্বিমত প্রকাশ করায় জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে তাঁর বিরোধ তৈরি হয়েছিল। ২০১৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি তাঁকে জামায়াত থেকে বহিষ্কার করা হয়। সম্প্রতি কালের কণ্ঠ’র উপসম্পাদক এনাম আবেদীনের সঙ্গে তিনি জামায়াতসহ নিজের নতুন দল সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন। ‘ডেইলি নাগরিক’ এর পাঠকের জন্য সাক্ষাতকারটি হুবুহু উপস্থাপন করা হলো

কালের কণ্ঠ : দেশে এত রাজনৈতিক দল থাকতে নতুন দল করতে গেলেন কেন?

মনজু : বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক দলগুলো একটি অন্যটির কাউন্টার হিসেবে ক্ষমতায় আসছে। বিএনপি ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগের ওপর প্রতিশোধ নেয়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে বিএনপির ওপর প্রতিশোধ নিচ্ছে। আমরা মনে করছি, নতুন প্রজন্মের কাছে দ্বিদলীয় এই রাজনীতি একসময় আর প্রাসঙ্গিক থাকবে না। ডাক বিভাগ যেমন আজ অনেকটা অপ্রয়োজনীয় হয়ে গেছে, ট্র্যাডিশনাল এই রাজনৈতিক দলগুলোও সময়ের আবর্তে পরিত্যক্ত হয়ে যাবে। সেই আশাবাদ নিয়ে নতুন দল করেছি।

কালের কণ্ঠ : কিন্তু সেই সফলতা আপনার দল পাবে, তার নিশ্চয়তা কী?

মনজু: আমরা সফল হবোই এমন নিশ্চয়তা নেই।  কিন্তু মনে করছি, কথা ও কাজের মিল ঘটিয়ে সামনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারলে সফলতা আসতেও পারে।  সফলতা নির্ভর করে শ্রম, মেধা ও পরিকল্পনার ওপর।

কালের কণ্ঠ: জামায়াতের সঙ্গে আপনাদের কর্মসূচির পার্থক্য কী?

মনজু : জামায়াত একটি ধর্মীয় দল। এবি পার্টি ইনক্লুসিভ; ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সবাই এই পার্টি করতে পারবে। তা ছাড়া জামায়াত ইসলামিক নাকি রাজনৈতিক দল, তা নিয়ে বিতর্ক আছে। কারণ রাজনৈতিক দলে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবাই থাকতে পারে। এমনকি এথিস্টও থাকতে পারে। তাই আমাদের টার্গেট হচ্ছে কল্যাণমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, যেটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্রে ছিল। সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক সুবিচার ও গণতন্ত্র; এগুলোই আমরা টার্গেট করেছি। তা ছাড়া জামায়াত একটি ক্যাডারভিত্তিক সংগঠন, যেটা এবি পার্টি নয়।

কালের কণ্ঠ : এবি পার্টিকে কারা এ পর্যন্ত সাধুবাদ জানিয়েছেন?

মনজু : আমরা প্রায় সব ধারার বিশিষ্টজনের অ্যাপ্রিসিয়েশন পেয়েছি। মানুষের অধিকার ও সেবা—এই আইডিয়ার কথা বলায় তাঁরা বলেছেন যে এ ধরনের একটি রাজনীতি বাংলাদেশে দরকার।

কালের কণ্ঠ : সুনির্দিষ্টভাবে নাম বলা যাবে?

মনজু : আমরা ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে দেখা করে কথা বলেছি। অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে দেখা করে ওনার মতামত নিয়েছি। এ ছাড়া ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন, বদিউল আলম মজুমদার, আ স ম রব, কাদের সিদ্দিকী, মাহমুদুর রহমান মান্না, অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক, জাফরুল্লাহ চৌধুরীসহ আরো বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সঙ্গে দেখা করে কথা বলেছি। অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী তো আমাদের অনুষ্ঠানেই এসেছিলেন।

কালের কণ্ঠ : তাঁরা কী বলেছেন?

মনজু : কামাল হোসেন সাহেবকে বলেছি যে আমাকে জামায়াত থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। নতুন একটি রাজনৈতিক দলের কথা আমরা ভেবেছি। উনি বলেছেন, ভালো চিন্তা তোমরা করতে পারলে আমি সাধুবাদ জানাই। ইউনূস সাহেব বলেছেন, ‘দেখ, রাজনীতির প্রতি আমার আগ্রহ নেই।’ তিনি বলেছেন, সোশ্যাল বিজনেসটাই তাঁর কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তবে তিনি বলেছেন, যেকোনো মুভমেন্টের সঙ্গে সোশ্যাল বিজনেস কানেক্টেড থাকতে হবে। অন্যথায় বাংলাদেশে রাজনীতি সম্ভব হবে না। তিনি এ-ও বলেছেন, ‘বাংলাদেশে যে-ই রাজনীতি করবে, তারা যদি মুক্তিযুদ্ধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়, মানবিকতা বোধ নিয়ে কাজ করে তাহলে তাদের সাধুবাদ জানাই।’

কালের কণ্ঠ : মুক্তিযুদ্ধের কথা তুললেন। এ দেশের মুক্তিযুদ্ধের ধারক-বাহক হিসেবে মানুষ আওয়ামী লীগকেই জানে…

মনজু : এ বিষয়টি দল ঘোষণার সময়ই আমরা স্পষ্ট করেছি। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধে কার অবদান বেশি কার কম—এই বিভাজন তৈরি হয়েছে। অথচ ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছেন তাঁরাই এখন পক্ষ-বিপক্ষের বিষয়টি সামনে আনছেন।

কালের কণ্ঠ : মুক্তিযুদ্ধের কৃতিত্ব তাহলে আওয়ামী লীগকে দিতে চান না?

মনজু : মুক্তিযুদ্ধের কৃতিত্ব আওয়ামী লীগকে দিতেই হবে। কারণ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল এবং ওই দলের নেতাদের নেতৃত্বেই মুজিব সরকার গঠিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ সংঘটনের সফলতা এবং মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশকে সংগঠিত করে পরিচালনার ব্যর্থতা—দুটিই আওয়ামী লীগের রয়েছে।

কালের কণ্ঠ : আপনার সাবেক দল জামায়াত তো স্বাধীনতাবিরোধী ছিল…

মনজু : তারা স্বাধীনতাবিরোধী, এটি জামায়াতের ডিক্লারেশনেই আছে। কিন্তু পরে তারা আবার বলেছে যে স্বাধীনতাকে তারা সম্মান করে ও মেনে নিয়েছে।

কালের কণ্ঠ : স্বাধীনতাবিরোধী অবস্থান প্রশ্নে জামায়াতের ভেতরে কোনো দ্বিধা-দ্বন্দ্ব দেখেছেন?  

মনজু : মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে জামায়াতের মধ্যে সব সময়ই দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিল। ১৯৭৭ সালের আগে আজকের ছাত্রশিবিরের নাম ছিল ইসলামী ছাত্রসংঘ। কিন্তু ছাত্রসংঘের সঙ্গে যেহেতু আলবদর রাজাকার গঠনের একটা যোগসূত্র ছিল, ফলে দলের মধ্যে একটা বিভক্তি হয় যে ছাত্রসংঘ নাম আমরা করব না। এ নিয়ে সাধারণ সদস্যদের কাউন্সিলে ভোটাভুটির মাধ্যমে ছাত্রসংঘ নামটি বাদ দেওয়া হয়। অর্থাৎ স্বাধীনতাযুদ্ধের বিরোধিতার বিষয়টি নিয়ে সব সময়ই প্রশ্নবিদ্ধ ছিল।

কালের কণ্ঠ : জামায়াত কেন ছাড়লেন?

মনজু : জামায়াত তো আমাকে বহিষ্কার করেছে।

কালের কণ্ঠ : কেন?

মনজু : কারণ পরিষ্কার। তারা বলেছে, আমি দলের নীতি ও কর্মসূচির ব্যাপারে দ্বিমত প্রকাশ করেছি। আমি সংস্কার ও দলে পরিবর্তন চেয়েছি। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে জামায়াতের ভূমিকার ব্যাপারে স্পষ্ট অবস্থান নেওয়ার দাবি জানিয়েছি।

কালের কণ্ঠ : এবি পার্টি মুক্তিযুদ্ধকে কিভাবে দেখে?

মনজু : বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ। এটিকে স্বীকার ও সম্মান করেই বাংলাদেশে রাজনীতি করতে হবে। বাংলাদেশের অস্তিত্ব অস্বীকার করলে তাদের এই দেশে রাজনীতি করার অধিকার নেই।

কালের কণ্ঠ : ভারতের ব্যাপারে আপনাদের অবস্থান কী?

মনজু : স্বাধীনতাযুদ্ধে তারা আমাদের সাহায্য করেছে। আত্মমর্যাদা বজায় রেখে ভারতের সঙ্গে আমরা সম্পর্ক রাখতে চাই। কথায় বলে, স্ত্রী বদল করা যায়, কিন্তু প্রতিবেশী বদল করা যায় না।

কালের কণ্ঠ : আওয়ামী লীগ, নাকি বিএনপি জোটে যাবেন?

মনজু : এখনই জোটে যাওয়ার কথা চিন্তা করিনি। তবে আহ্বান করলে রাজনৈতিক সুবিধা-অসুবিধা আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, বাম ও ইসলামপন্থী—এই চারটি জোট রয়েছে। জাতীয় ঐক্যের কারণে আমরা কারো সঙ্গে বিরোধ চাই না।

কালের কণ্ঠ : আত্মপ্রকাশের দিন আপনারা বলেছেন, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ বিনির্মাণ করেছেন…

মনজু : বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে—এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। এটি সংবিধানেও বলা আছে। তবে জাতীয় নেতাদের সব ধরনের বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখা উচিত বলে মনে করি। ইদানীং জামায়াতও বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা বলেছে।

কালের কণ্ঠ : করোনা পরিস্থিতির মধ্যে আত্মপ্রকাশ করায় অনেকেই মনে করছে সরকারের সঙ্গে আঁতাত রয়েছে…

মনজু : এগুলো অপপ্রচার। আমরা সরকারের প্রজেক্ট বা জামায়াতের বি-টিম কোনোটাই নই। মজার ব্যাপার হলো, আমরা এখন সরকার ও জামায়াতের তীব্র বিরোধিতার মুখে পড়েছি।

কালের কণ্ঠ : বঙ্গবন্ধুকে আপনারা জাতির পিতা মানেন কি না?

মনজু : আমরা মনে করি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি। এটি ঐতিহাসিক সত্য। তবে তিনি তাঁর জীবদ্দশায় নিজেকে জাতির পিতা দাবি করেছেন কি না, এটি একটি প্রশ্ন। দ্বিতীয়ত, তিনি কোন জাতির পিতা? বাঙালি জাতি বললে হাজার বছরের বাঙালি জাতির ইতিহাস আছে। তাই আমি একটু কৌশলী জবাব দিয়ে বলতে চাই, যদি এমন বাংলাদেশ হয়, যেখানে গণতন্ত্র আছে, ভোটাধিকার আছে, ন্যায়বিচার আছে, এ রকম একটা দেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বলা হলে আমি মেনে নিতে রাজি আছি। কিন্তু যে দেশে ভোটাধিকার নেই, শিশু ধর্ষিত হয়, করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও চুরি হয় সে দেশে বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা হিসেবে বলে আমি বঙ্গবন্ধুকে অপমান করতে চাই না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *