আমি ভয় পাচ্ছি ভাইরাস স্যুয়ারেজ হয়ে পানিতে যাচ্ছে কি-না- ড. বিজন

Spread the love

দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর পর গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের অ্যান্টিবডি টেস্টের কিট উদ্ভাবনের খবর নিয়ে দেশজুড়ে তৈরি হয় আলোড়ন। এখনো সরকারের তরফ থেকে ওই কিট অনুমোদন না পেলেও প্রক্রিয়া থেমে নেই। আর এই কিট উদ্ভাবনে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের সঙ্গে উঠে আসে বিজ্ঞানী ড. বিজন কুমার শীলের নাম। এই বিজ্ঞানী গত চার মাসে কিট প্রসঙ্গ ছাড়াও আলোচনায় আসেন করোনার গতি-প্রকৃতি নিয়ে অন্যদের চেয়ে অনেকটাই আলাদা পর্যবেক্ষণ ও মতামত তুলে ধরে। তাঁর সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণ উঠে এসেছে জাতীয় দৈনিক কালের কণ্ঠ’র সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কালের কণ্ঠ’র উপপ্রধান প্রতিবেদক তৌফিক মারুফ। ডেইলি নাগরিক এর পাঠকদের জন্য সাক্ষাতকারটি হুবুহু উপস্থাপন করা হলো

কালের কণ্ঠ : কেমন আছেন আপনি? কভিড-১৯ সম্পর্কে আপনার সর্বশেষ পর্যবেক্ষণ কী?

বিজন শীল : ভালো আছি। যেকোনো মহামারি অনেকটা সাইক্লোনের মতো ঝোড়ো বেগে এসে ক্ষয়ক্ষতি করে দুমচেমুচড়ে দিয়ে একপর্যায়ে দুর্বল হয়ে শেষ হয়ে যায়। কভিড-১৯ নিয়ে আমি মনে করি, এর ব্যতিক্রম হবে না। কোনো মহামারি চিরস্থায়ী নয়। এ ক্ষেত্রে আমি আগেও বলেছি ঢাকায় সংক্রমণের পিক চলে গেছে। ঢাকার বাইরে কোথাও কোথাও বাড়ছে—সেটাই স্বাভাবিক। সংক্রমণও কমছে। তবে এখন আরেকটি বিষয় দেখার মতো, সেটি হচ্ছে আমরা কোন দিকে যাচ্ছি, আমাদের দেশ থেকে করোনা বিদায় করতে আর কত দিন লাগতে পারে—সেই বিষয়টি। এ ক্ষেত্রে আমি মনে করি, আমাদের জনসংখ্যার ভেতর যথেষ্ট অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে। ফলে সংক্রমণও নিয়ন্ত্রণে আসছে আপনা-আপনি। তবে এখন যদি আমরা অ্যান্টিবডি টেস্ট চালু করতে পারি, তবেই আমরা তার ফলাফল হিসাব করে নিশ্চিত হতে পারব আর কত দিনের মধ্যে দেশ থেকে করোনা বিদায় নেবে।

কালের কণ্ঠ : করোনার গতি-প্রকৃতি ও চরিত্র পাল্টাচ্ছে—এমনটি বলছেন অনেকেই, আপনি কী দেখছেন?

বিজন শীল : হ্যাঁ, এটা ঠিক কথা। করোনার গতিবিধি এখন কিন্তু সঠিকভাবে ধারণা করা জটিল হয়ে পড়েছে। খুব দ্রুত মিউটেশন হচ্ছে। কেবল বাংলাদেশেই নয়, সারা বিশ্বেও একই অবস্থা। নতুন নতুন উপসর্গ দেখা যাচ্ছে। আমাদের এখানেও তাই ঘটছে।

কালের কণ্ঠ : আমাদের দেশে আক্রান্তদের মধ্যে উপসর্গে কী ধরনের নতুনত্ব আপনি দেখছেন?

বিজন শীল : এই যেমন ধরুন, প্রথম দিকে ছিল সামান্য জ্বর, সর্দি-কাশি ও গলাব্যথা থেকে শ্বাসকষ্ট। কিন্তু এখন ডায়রিয়া কমন হয়ে পড়েছে বলে দেখা যাচ্ছে। এখান থেকে আমি ভয় পাচ্ছি স্যুয়ারেজ হয়ে পানিতে যাচ্ছে কি না। পানিতে করোনাভাইরাস কী অবস্থায় ছড়ায়, সে সম্পর্কে কিন্তু এখনো পরিষ্কার ধারণা আসেনি। যেমনটা শুরুতে বাতাসে ছড়ায় না বলা হলেও এখন সেটা হচ্ছে।

কালের কণ্ঠ : দেশে সংক্রমণ বাড়লেও মৃত্যু তো কমছে, তো যদি জটিলতা বেশি থাকবেই তবে মৃত্যু কম কেন?

বিজন শীল : সংক্রমণ ঠিক বাড়ছে, বলা যাবে না। সংক্রমণ কিন্তু গড়ে কমের দিকেই আছে। মৃত্যুহার তো কমে গেছেই। আর চরিত্র বা গতিবিধি পাল্টানো মানে সেটা আগের তুলনায় শক্তিশালী হচ্ছে না। বরং মারাত্মক অবস্থা থেকে তুলনামূলক দুর্বল হচ্ছে। ফলে এখন যাঁরা মারা যাচ্ছেন তাঁরা আগে থেকেই নানা জটিল অবস্থায় ছিল।

কালের কণ্ঠ : অনেকে দ্বিতীয়বার সংক্রমিত হওয়ার কথা বলছেন, আপনার মত কী?

বিজন শীল : যাঁরা বলছেন তাঁরা কিসের ভিত্তিতে বলছেন, কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন কি না, সেটা দেখতে হবে। এটা হতে পারে অনেকের মধ্যে ভাইরাস দীর্ঘদিন মুখে বা নাকের ভেতর থেকে যায়। হয়তো দেখা গেল তাঁর অন্য কোনো কারণে সর্দি বা হাঁচি-কাশি হলো, তখন যদি তাঁর পরীক্ষা করা হয়?হয়তো আরটিপিসিআর টেস্টের রেজাল্ট পজিটিভ আসবে। কিন্তু সেই উপসর্গ ওই ভাইরাসের জন্য নয়। কারণ ওই ভাইরাস ডেড ভাইরাস, সক্রিয় নয়। তবুও বলব, এই বিষয়গুলো নিয়ে দেশে ভালো একটা সমীক্ষা হওয়া প্রয়োজন, যা থেকে মিউটেশন পরিস্থিতি যেমন বুঝতে পারা যাবে, আবার রি-ইনফেশন নিয়ে মানুষের বিভ্রান্তিও দূর হবে।

কালের কণ্ঠ : করোনা সংক্রমণ, গতি-প্রকৃতি কিংবা প্রতিরোধ নিয়ে দেশে কি পর্যাপ্ত গবেষণা হচ্ছে?

বিজন শীল : এক কথায় বলতে গেলে এখনো তেমন কোনো গবেষণা শুরুই হয়নি। যা হচ্ছে সেগুলো হলো কিছু ছোট পরিসরে সমীক্ষার মতো। এগুলোকে ঠিক গবেষণা বলা যায় না। তবে আমাদের দেশে গবেষণা শুরুর মতো অল্পসংখ্যক বিজ্ঞানী কিন্তু আছেন। তাঁরা চাইলে ভালো কাজ করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে উপযুক্ত মানের ল্যাবরেটরি ও অর্থ।

কালের কণ্ঠ : ভ্যাকসিন নিয়ে মানুষ আশাবাদী হচ্ছে, বিষয়টিকে কিভাবে দেখছেন?

বিজন শীল : আমিও স্বাভাবিকভাবেই আশাবাদী হতে চাই। তবে এ ক্ষেত্রে মিউটেশনের সঙ্গে তাল মেলাতে না পারলে সুফল পাওয়া কিছুটা কঠিন হবে। কারণ এখন করোনা সংক্রমণ হচ্ছে মিউকাস অ্যাসোসিয়েটেড। ভ্যাকসিন হতে হবে সেই মোতাবেক। অ্যান্টিবডি কিভাবে কতটা হচ্ছে, না হচ্ছে তার ওপর নির্ভর করবে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা।

কালের কণ্ঠ : আপনাদের অ্যান্টিবডি ও অ্যান্টিজেন পরীক্ষা কিটের এখন কী অবস্থা?

বিজন শীল : অ্যান্টিবডি কিটের আরেক দফা নিজস্ব মূল্যায়ন করে তার প্রতিবেদন ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরে জমা দিয়েছি গত সপ্তাহে। এখন তাদের নির্দেশনার অপেক্ষায় আছি। আর অ্যান্টিজেন টেস্ট কিট নিয়ে আরো কিছু কাজ চলছে।

কালের কণ্ঠ : এখন আপনি কি আর কোনো গবেষণা করছেন?

বিজন শীল : প্রধানত করোনা নিয়ে কাজ করছি। তবে এর মধ্যেই ডেঙ্গুর আরেকটি নতুন টেস্ট কিট উদ্ভাবনের কাজও করছি। এটা সফল হলে বড় একটি উদ্ভাবন হতে পারে। ওই একটি কিট দিয়ে ডেঙ্গুর তিন ধরনের পরীক্ষার ফল পাওয়া যাবে, যা থ্রি ইন ওয়ান বলা যায়।

কালের কণ্ঠ : এখন পর্যন্ত আপনার মোট কতটি উদ্ভাবন রয়েছে?

বিজন শীল : এ পর্যন্ত আমার নিজস্ব ১৫টি প্যাটেন্ট বা মেধাস্বত্ব রয়েছে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। এর মধ্যে ১৪টি ডায়াগনস্টিক কিটের। আরেকটি হচ্ছে বৈদ্যুতিক পাখা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের, যেটা মূলত জ্বালানি খাতের উদ্ভাবন। আমি মাঝখানে প্রাণী বা স্বাস্থ্য খাত থেকে বেরিয়ে জ্বালানি খাতে কাজ করেছিলাম। তখন ওই উদ্ভাবন করেছি। এ ছাড়া ২০১৬ সাল থেকে আরেকটি উদ্ভাবন রয়েছে ভারতে, বাংলাদেশে এখন আনব। এটি হচ্ছে সিরিজ মাল্টিশিওর টেস্ট কিট; পাঁচটি টেস্ট একসঙ্গে করা যায়, যা দিয়ে হেপাটাইটিসের দুটি, এইচআইভি, ব্লাড স্ক্রিনিং ও ডেঙ্গুর পরীক্ষা করা যায়। এ ছাড়া ২০০৩ সালে সার্সের সময় ডট ব্লড কিট উদ্ভাবন করেছিলাম। যেটা এখন সংস্কার করে এবার করোনার অ্যান্টিবডি কিট হিসেবে নিয়ে এসেছি। আগে টেস্টে সময় লাগত পাঁচ মিনিট, এবার করেছি তিন মিনিট। এর আগে প্রাণিসম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠানে চাকরির সময় আমি ছাগলের একটি ভ্যাকসিন তৈরি করি, যেটা এখনো দেশে চলছে। এ ছাড়া সিমাক নামে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অনুমোদনকৃত পাঁচটি কিট আছে।

কালের কণ্ঠ : আপনার বেড়ে ওঠা কিভাবে?

বিজন শীল : আমার বাড়ি নাটোরের বনপাড়া উপজেলার কালিকাপুর গ্রামে। আমি সেখানকার সেন্টস জোসেফ থেকে এসএসসি, এডওয়ার্ড কলেজ থেকে এইচএসসি শেষ করে ভেটেরিনারি সায়েন্সে ভর্তি হই। সেখান থেকেই অনার্স-মাস্টার্স করে প্রাণিসম্পদে চাকরি নিই। তা ছেড়ে সিঙ্গাপুরে চলে যাই। সেখানে গিয়ে গবেষণায় আরো মনোযোগী হই। সেই থেকে কিট উদ্ভাবনে হাতেখড়ি। এখনো কাজ চলছে।

কালের কণ্ঠ : আপনার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে যদি কিছু জানান।

বিজন শীল : আমার স্ত্রী ভেটেরিনারি চিকিৎসক। দুই সন্তান। ছেলে এরোস্পেস সায়েন্সে পড়াশোনা শেষ করেছে। মেয়ে পড়ছে সিঙ্গাপুরে কেমিক্যাল সায়েন্সে। এখন মা ও মেয়ে সিঙ্গাপুরে আছে। আমি আর ছেলে ঢাকায়।

কালের কণ্ঠ : অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন।

বিজন শীল : কালের কণ্ঠকেও ধন্যবাদ। কালের কণ্ঠ’র আরো অগ্রযাত্রা কামনা করি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *