পশু উৎসর্গের বিধানে আছে সব ধর্মে

Spread the love

নাগরিক ডেস্ক : ইসলামের অন্যতম ইবাদত কোরবানি। মহান আল্লাহ আগের নবীদের জন্যও এই বিধান রেখেছিলেন। ইরশাদ হচ্ছে, ‘আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য কোরবানির নিয়ম করে দিয়েছি, যাতে আমি তাদের জীবনোপকরণস্বরূপ যেসব চতুষ্পদ জন্তু দিয়েছি, সেগুলোর ওপর তারা আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে।’ (সুরা হজ, আয়াত : ৩৪)

কোরবানির ইতিহাস খুঁজলে দেখা যায়, মানব ইতিহাসের সর্বপ্রথম কোরবানি হলো আদম (আ.)-এর দুই পুত্র হাবিল ও কাবিলের কোরবানি। এ ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘আদমের পুত্রদ্বয়ের (হাবিল-কাবিলের) বৃত্তান্ত তুমি তাদের যথাযথভাবে শোনাও। যখন তারা উভয়ে কোরবানি করেছিল, তখন একজনের (হাবিলের) কোরবানি কবুল হলো ও অন্যজনের কবুল হলো না। তাদের একজন বলল, আমি তোমাকে হত্যা করবই। অন্যজন বলল, আল্লাহ খোদাভীরুদের কোরবানি কবুল করেন।’ (সুরা মায়েদা, আয়াত : ২৭)

কোরবানির ইতিহাসে নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন ইবরাহিম (আ.) ও তাঁর পুত্র ইসমাঈল (আ.)। মহান আল্লাহর হুকুম পালনে ইবরাহিম (আ.)-এর অতুলনীয় ত্যাগ ও ইসমাঈল (আ.)-এর ধৈর্য আল্লাহর এতই পছন্দ হয়েছে যে তিনি তাঁদের ইতিহাস স্মরণীয় রাখার জন্য সব সচ্ছল মানুষের জন্য কোরবানির বিধান দিয়েছেন।

ইবরাহিম (আ.) ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুসলমানদের কাছে শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। তাই আসমানি এই তিন ধর্মে কোরবানির বিধান রয়েছে। সনাতন ধর্মেও পশু উৎসর্গের বিধান দেখা যায়। ফলে দেখা যায়, সব ধর্মেই নিজ নিজ বিশ্বাস অনুযায়ী সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টি বিধানের জন্য ‘কোরবানি’র বিধান আছে। তবে দেশ ও ধর্মভেদে এর পৃথক নাম রয়েছে। সবাই এটাকে কোরবানি বলে না। বলা হয় ‘বলি’, ‘ঈশ্বরের জন্য রক্তোৎসর্গ’ ইত্যাদি। আরবিতে ‘উদহিয়্যাহ’ শব্দের অর্থ ‘রক্তোৎসর্গ’। তবে উর্দু ও ফারসি ভাষায় আরেকটি আরবি শব্দ ‘কোরবান’ থেকে ‘কোরবানি’ কথাটার প্রচলন হয়েছে।

সনাতন ধর্মের পশু উৎসর্গের বিধান : হিন্দু ধর্মে পাঁঠা বলির কথা সর্বজনসিদ্ধ। এখানে দেবীর উদ্দেশে পাঁঠা বলি দেওয়া হয়। ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী, পায়ের পদতলে পশুত্বকে বিসর্জন দেওয়া হয়। অনেক হিন্দু ধর্মাবলম্বী বিশ্বাস করেন যে মা স্বয়ং এই বলি গ্রহণ করেন। ফলে বলি দেওয়া পাঁঠার মাংস তুলনামূলক কম স্বাদের হয়ে থাকে। এই স্বাদটা মা গ্রহণ করেন।

নেপালে প্রতি পাঁচ বছরে একবার উদ্যাপিত গড়িমাই উৎসবে হাজার হাজার তীর্থযাত্রী একত্র হয়ে প্রায় পাঁচ লাখ গরু বলি দেয়।

নেপাল সম্পর্কে ন্যাশনাল জিওগ্রাফির ভাষ্য অনুযায়ী, এই দেশে একই এলাকায় পৃথিবীর সর্বোচ্চসংখ্যক পশু বলি দেওয়া হয়। প্রতি পাঁচ বছর পর পর শক্তির দেবী গাধিমাইকে খুশি করার জন্য হাজার হাজার পশু বলি দেওয়া হয়। তবে এই উৎসবের সূত্রপাত নিয়ে হিন্দু ধর্মে বিভিন্ন বক্তব্য পাওয়া যায়। ধর্মাচার্য অধ্যাপক ড. বেদপ্রকাশ উপাধ্যায় লিখিত ‘হিন্দু ধর্মগ্রন্থ বেদ ও পুরাণে আল্লাহ ও হযরত মোহম্মদ’ বইয়ে লিখেছেন, ‘‘আদিকালে ব্রহ্মার দুই পুত্র ছিল—অথর্ব ও অঙ্গিরা। তিনি ঐশী প্রত্যাদেশপ্রাপ্ত হইয়া জ্যেষ্ঠ পুত্র অথর্বকে বলি দিতে উদ্যত হন। শাস্ত্রে উহা ‘পুরুষ মেধযজ্ঞ’ নামে খ্যাত। অদ্যাবধি নরবলির স্থলে পশুবলি দ্বারা উহা পালিত হইতেছে এবং বলি দেওয়ার সময় উক্ত পুরুষ মেধযজ্ঞের সূত্রগুলি পঠনের বিধান আছে।’’ (অথর্ববেদ দশম কাণ্ড, প্রথম অনুবাক দ্বিতীয় সুক্ত ২৬-৩৩ মন্ত্র)

ইহুদি ধর্মে পশু উৎসর্গ : হুবহু মুসলমানদের মতো না হলেও ইহুদি ধর্মেও কয়েক ধরনের কোরবানি রয়েছে। যার মধ্যে পাঁচটি মৌলিক (পোড়ানো কোরবানি, শস্য কোরবানি, গুনাহের কোরবানি, যোগাযোগ কোরবানি, দোষের কোরবানি)। এ ছাড়া রয়েছে শাখা কোরবানি। সেগুলোর বিবরণ হলো—ঢালন কোরবানি মানে কোরবানি হিসেবে কোনো তরল পদার্থ কোরবানগাহের ওপর অথবা মাটিতে ঢেলে দিয়ে দেখানো হতো যে এটা আল্লাহর কাছে দেওয়া হলো। (লেবীয় ২৩:১৩)

দোরণ কোরবানি অন্য কোরবানির মতোই। তবে পার্থক্য হলো, ধর্মগুরু সাহেব কোরবানির জিনিস থেকে কিছু অংশ তুলে নিয়ে দুলিয়ে রাখতেন। (লেবীয় ৭:৩১)

দোষ কোরবানি হলো কোরবানির জিনিস আনার আগে গুনাহের ক্ষতিপূরণমূলক কোরবানি। (লেবীয় ৫:১৬)

ধপ কোরবানি হলো, আল্লাহর কাছে দেওয়া কতগুলো কোরবানির সঙ্গে ধূপ, যা কোরবানি করা হতো। (লেবীয় ১৬:১২)

গুনাহ কোরবানি হলো, গুনাহ থেকে পাকসাফ হওয়ার জন্য আল্লাহর উদ্দেশে নানা রকম পশু ও খাবার কোরবানি দেওয়া। এই কোরবানি একজন লোকের পক্ষে অথবা সমগ্র জাতির পক্ষে দেওয়া যেত।

পোড়ানো কোরবানি হলো, কোরবানির বস্তুর সম্পূর্ণটাই কোরবানগাহের ওপর পোড়ানো হতো। এ ছাড়া রয়েছে প্রথমে তোলা শস্যের কোরবানি। ফসল তোলার বা কাটার সময় প্রথম তোলা বা কাটা ফসল আল্লাহকে দেওয়া হতো। (লেবীয় ২:১২-১৬)

যোগাযোগ কোরবানি শুকরিয়া আদায় কিংবা মানত পূরণের জন্য দেওয়া হতো। আবার নিজের ইচ্ছায় করা কোরবানি হিসেবেও এটা করা যেত।

শস্য কোরবানি হলো, শুকরিয়া জানানোর জন্য এবং আল্লাহর রহমত পাওয়ার জন্য লবণ দেওয়া খামিহীন পিঠা অথবা শস্য দিয়ে কোরবানি।

সকালবেলার কোরবানি ও সন্ধ্যাবেলার কোরবানি হলো একরকম পোড়ানো কোরবানি, যা প্রতিদিন দেওয়া হতো। (সূত্র : কিতাবুল মোকাদ্দস, পৃষ্ঠা ৩৯০)

খ্রিস্ট ধর্মে কোরবানি : কিতাবুল মোকাদ্দাসে উল্লেখ রয়েছে যে ইউসুফ ও মরিয়ম ঈসা মসিহের জন্মের সময় দুটি কবুতর কোরবানি করেছেন। সেই থেকে গ্রিসে পশু উৎসর্গ একটি কমন প্রথা। সেখানে সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে একেশ্বরবাদী অর্থোডক্স চার্চে বকরি ও মুরগি দেওয়া একটি সুপ্রাচীন রীতি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *