বাবুনগরী হেফাজতের আমির!

Spread the love

নাগরিক ডেস্ক: সব জল্পনা-কল্পনাকে পেছনে ফেলে অবশেষে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির হচ্ছেন সিনিয়র মুহাদ্দিস আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী! অরাজনৈতিক সংগঠনটির বর্তমান মহাসচিব তিনি।

রোববার (১৫ নভেম্বর) হতে যাচ্ছে হেফাজতের কেন্দ্রীয় সম্মেলন (কাউন্সিল)। সংগঠনটির জন্মস্থান ও সদর দপ্তর হাটহাজারী আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম মাদ্রাসায় এই সম্মেলনে অংশ নেবেন ৩৫০ জন কাউন্সিলর। ভোটাভুটি নয়, দেশের বিভিন্ন এলাকার এই শুরা সদস্যরাই নিজেদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করবেন কে হবেন সংগঠনটির পরবর্তী আমির। যিনি দেশের শীর্ষ কওমি আলেম প্রয়াত আল্লামা শাহ আহমদ শফীর স্থলাভিষিক্ত হবেন। আহমদ শফী গত ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করার পর থেকে আমিরের পদটি শূন্য রয়েছে।

নতুন আমির হওয়ার ক্ষেত্রে অবশ্য আরো কয়েকজন শীর্ষ নেতার নামও জোরেশোরে আলোচনায় রয়েছে। তাদের মধ্যে আছেন হেফাজতের সিনিয়র নায়েবে আমির আল্লামা মহিবুল্লাহ বাবুনগরী, নায়েবে আমির আব্দুল কুদ্দুস, কওমি মাদ্রাসাগুলোর শিক্ষা বোর্ড বেফাক সভাপতি ও সরকারি স্বীকৃতি নিতে গঠিত আল হাইয়াতুল উলায়া লিল-জামি’আতিল কওমিয়ার ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আল্লামা মাহমুদুল হক, নায়েবে আমির ও ঢাকার আমির মাওলানা আল্লামা নূর হোসেন কাশেমী এবং হাটহাজারী মাদ্রাসার সহকারী পরিচালক আল্লামা শেখ আহমদ।

তাদের মধ্যে আল্লামা মহিবুল্লাহ বাবুনগরী হলেন আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীর মামা। মামা-ভাগ্নের সখ্যে শেষ পর্যন্ত ভাগ্নে জুনায়েদ বাবুনগরীকেই আমির পদে সমর্থন দিতে পারেন মামা মহিবুল্লাহ বাবুনগরী- এমন আভাস রয়েছে।

হেফাজতের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী সারাক্ষণকে বলেন, কেন্দ্রীয় সম্মেলন সফলে সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। দেশের ৬৪টি জেলা থেকে ৩৫০ জন শীর্ষনেতা সম্মেলনে অংশ নেবেন। তারাই সম্মেলনের কাউন্সিলর ও শুরা কমিটির সদস্য। তাদের মতামতের ভিত্তিতে হেফাজতের পরবর্তী আমিরকে নির্বাচিত করা হবে।

আজিজুল হক দাবি করেন, নতুন আমির হিসেবে দেখা যেতে পারে বর্তমান মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরীকে। শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে তৃণমূল পর্যায়ে তার আলাদা জনপ্রিয়তা রয়েছে।

২০১০ সালের ১৯ জানুয়ারি গঠিত হয় চট্টগ্রামকেন্দ্রিক কওমি আক্বিদাপন্থী সংগঠন হেফাজত। হাটহাজারী আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম মাদ্রাসার প্রয়াত মহাপরিচালক শাহ আহমদ শফীকে আমির ও তৎকালীন সিনিয়র মুহাদ্দিস জুনায়েদ বাবুনগরীকে মহাসচিব করে ২২৯ সদস্যের মজলিশে শুরা কমিটি গঠন করা হয়েছিল তখন।

ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষানীতির বিরোধিতার মধ্য দিয়ে আত্মপ্রকাশ ঘটলেও সংগঠনটি দেশজুড়ে আলোচনায় আসে ২০১৩ সালে ১৩ দফা দাবিতে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। বিশ্বজুড়ে আলোচনায় আসে ২০১৪ সালে ৫ মে শাপলা চত্বর অবরোধের মাধ্যমে।

শাহ আহমদ শফীর মৃত্যুর পর তার গ্রুপ হেফাজতের ভেতরে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। জুনায়েদ বাবুনগরী ও তার গ্রুপ সংগঠনেও যেমন চাঙা, হাটহাজারী মাদ্রাসার নিয়ন্ত্রণও তেমনি তাদের কাছেই। তাই তার সংগঠনটির শীর্ষনেতা হওয়াটা সময়ের ব্যাপারমাত্র বলে মনে করছেন অনুসারীরা।

অবশ্য এর আগে আল্লামা শফীর ব্যাপক জনপ্রিয়তা থাকায় দীর্ঘদিন বাবুনগরীর গ্রুপটিই কোণঠাসা ছিল। তবে প্রকাশ্যে শফী গ্রুপের সঙ্গে সংঘর্ষে না জড়িয়েও অনেক আগে থেকেই ভেতরে ভেতরে সংগঠিত হতে থাকেন তারা। বিশেষ করে হাটহাজারী মাদ্রাসাকে কীভাবে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয়া যায়, সেই পরিকল্পনার ছক আঁকতে থাকেন তারা। হেফাজতের মহাসচিবের মতো মাদ্রাসারও গুরুত্বপূর্ণ পদে যেতে মরিয়া হয়ে ওঠেন জুনায়েদ বাবুনগরী। অবশেষে ২০১৭ সালের ১৫ জুলাই সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী কমিটি মজলিশে শুরার সভায় মাদ্রাসার সহকারী পরিচালকের পদ লাভ করে নিজের পরিকল্পনা অনুসারে এগিয়ে যেতে থাকেন।

হাটহাজারী মাদ্রাসাকেন্দ্রিক শফী গ্রুপ ও বাবুনগরী গ্রুপের বিরোধ প্রকাশ্যে আসে মাস ছয়েক আগে থেকে। ওই সময় আহমদ শফী ঘন ঘন অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন। এই সুযোগে বাবুনগরীর অনুসারীরা প্রচার করতে থাকেন, শফী হুজুর অসুস্থতার কারণে মাদ্রাসার মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করতে না পারায় পরবর্তী মহাপরিচালক হতে যাচ্ছেন জুনায়েদ বাবুনগরী। এর অংশ হিসেবে গত ১৬ মে হাটহাজারী মাদ্রাসা মসজিদে জোহরের নামাজের পর উপস্থিত মুসল্লিদের সামনে জুনায়েদ বাবুনগরীকে ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক হিসেবে ঘোষণা দেন হাটহাজারী ওলামা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মাওলানা জাফর। এ সময় শফীর অনুসারীরা প্রতিবাদ জানান।

ওই দিন রাতেই আহমদ শফী ঘোষণা দেন, মাদ্রাসার জিম্মাদারি কাউকে দেয়া হয়নি। মজলিশে শুরা ঠিক করবেন, কে হবেন এই মাদ্রাসার জিম্মাদার। মাসখানেক পর ১৭ জুন মজলিশে শুরার বৈঠকে জুনায়েদ বাবুনগরীকে হাটহাজারী মাদ্রাসার সহকারী পরিচালকের পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। ওই বৈঠকেই সহকারী পরিচালক নিযুক্ত হন মোহাদ্দিস মাওলানা শেখ আহমদ। সেই সঙ্গে আমৃত্যু আল্লামা শফীকে হাটহাজারী মাদ্রাসার মহাপরিচালক হিসেবে রাখার সিদ্ধান্ত হয়।

এর পর থেকে দুই গ্রুপের বিরোধ চরম আকার ধারণ করে। যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে গত ১৬ সেপ্টেম্বর শফী হুজুরের ছেলে আনাস মাদানীকে হাটহাজারী মাদ্রাসা থেকে বহিষ্কারসহ পাঁচ দফা দাবিতে মাদ্রাসাটির হাজার হাজার শিক্ষার্থীর আন্দোলন শুরুর মধ্য দিয়ে।

গত ১৮ সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করার তিন দিন আগ পর্যন্তও আহমদ শফীর সাম্রাজ্যখ্যাত হাটহাজারী মাদ্রাসা তার নিজের নিয়ন্ত্রণেই ছিল। কিন্তু মৃত্যুর দুদিন আগে থেকে জুনায়েদ বাবুনগরীর গ্রুপের কাছে এর নিয়ন্ত্রণ চলে যায়। বাবুনগরীর অনুসারীরা ওই মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের দিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলেন। সেই আন্দোলনের মুখে আল্লামা আহমদ শফী তার ছেলে আনাস মাদানীকে মাদ্রাসাটির শিক্ষা পরিচালকের পদ থেকে বরখাস্ত করতে বাধ্য হন। এমনকি নিজেও মাদ্রাসাটির মহাপরিচালকের পদ থেকে অব্যাহতি নেন। ইচ্ছার বিরুদ্ধে এমন দুটি কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়ার পর মানসিকভাবে বিপর্যস্ত আহমদ শফী শারীরিকভাবেও গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাকে মাদ্রাসা থেকে অ্যাম্বুলেন্সযোগে হাসপাতালে নেয়া হয়। হাসপাতাল থেকে আর জীবিত অবস্থায় ফিরে আসতে পারেননি। মানসিক কষ্ট নিয়েই চলে যান না ফেরার দেশে।

আহমদ শফীর মৃত্যুর পর হাটহাজারী মাদ্রাসায় একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছেন জুনায়েদ বাবুনগরী। তার ইশারাতেই চলছে সবকিছু। বাবার মৃত্যুর পর মাদ্রাসায় ঠাঁই হয়নি ছেলে আনাস মাদানীরও। শফী গ্রুপ পুরোপুরি কোণঠাসা হয়ে পড়ায় দুই গ্রুপের মধ্যে এখন নেই কোনো উত্তাপ-উত্তেজনা। শফীর অনুসারীদের মাঝে চাপা ক্ষোভ থাকলেও মাদ্রাসাটিতে তাই শান্তিপূর্ণ পরিবেশ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *