ইলিশের অভয়াশ্রম মেঘনায় হবে অর্থনৈতিক অঞ্চল

Spread the love

নাগরিক রিপোর্ট : ইলিশের ভরপুর মৌসুমে এবার সবচেয়ে বেশী আলোচিত বিষয়- নদ-নদীতে ইলিশ সংকট। ইলিশের খনি খ্যাত ষষ্ঠ অভয়াশ্রম বরিশালের হিজলা-মেহেন্দিগঞ্জের পাশ দিয়ে প্রবাহিত মেঘনায় সারাদিন জাল ফেলে শুন্যহাতে ফিরতে হচ্ছে জেলেদের। বিষয়টি নিয়ে এ বছর মৎস্য বিশেষজ্ঞদের কপালেও চিন্তার ভাজ, ইলিশ নিয়ে এমন দু:সময়ের মধ্যে আরেকটি খবরে নতুন উদ্বেগ দেখা দিয়েছে মৎস্য অধিদপ্তরে।
ইলিশের ষষ্ঠ অভয়াশ্রম মেঘনার মাঝে দ্বীপের মতো জেগে ওঠা ‘চরমেঘা’য় অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েেেছ বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)। দূর্গম এ চরটি বরিশালের হিজলা উপজেলার গৌরবদী ইউনিয়নের অর্ন্তভূক্ত।
মৎস্য অধিদপ্তরের দায়িত্বশীলরা বলছেন, ‘চরমেঘায় অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপিত হলে তা হবে ইলিশের জন্য চুড়ান্ত ক্ষতি। মেঘনার এ অংশটি ইলিশসহ বিভিন্ন প্রজাতির মৎস্যপ্রাণীর সবচেয়ে বড় প্রজননক্ষেত্র’।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এতে শুধু ইলিশ নয়, মেঘনায় জীববৈচিত্র হুমকির মুখে পড়বে। এর আগে ইলিশের আরেক অভয়াশ্রম বরগুনার পায়রা নদীর তীরে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের পর সেখানেও ইলিশসহ অন্যন্য মৎস্যপ্রাণীকূলে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
বরিশালের জেলা প্রশাসক মো. জসীম উদ্দীন হায়দার সমকালকে বলেন, চরমেঘায় অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের জন্য প্রস্তাব ইতিমধ্যে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। অনুমোদিত হলেই প্রশাসনিক কার্যক্রম শুরু হবে। সম্প্রতি তিনি জানতে পেরেছেন ওই এলাকটি ইলিশসহ অন্যান্য মাছের প্রজননক্ষেত্র। দেশের মৎস্যসম্পদ রক্ষার বিষয়টিও তারা গুরুত্বসহকারে নিয়েছেন। প্রজনক্ষেত্র নিরাপদ রেখে অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের বিষয়ে নতুন করে ভাবা হচ্ছে।
উল্লেখ্য, এর আগে ২০১৭ সালে পরমানু শক্তি কমিশন চরমেঘযায় ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন পারমানিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের উদ্যেগ মৎস্য অধিদপ্তরের তীব্র আপত্তির মুখে তা নাকচ হয়।
মৎস্য অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগীয় উপ পরিচালক মো. আনিছুর রহমান বলেন, চরমেঘায় অর্থনৈতিক অঞ্চল হলে মৎস্যসম্পদের কি ধরনের ক্ষতি হতে পারে তার প্রতিবেদন অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয় থেকে তার কাছে চাওয়া হয়। জেলা মৎস্য ও কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামনের সঙ্গে সমম্বয় করে তিনি (উপ-পরিচালক) এ বিষয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন গত সপ্তাহে প্রেরন করেছেন।
উপ পরিচালক বলেন, ‘হিজলা-মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার পাশ দিয়ে প্রবাহিত মেঘনা দেশের সব প্রজাতির মৎস্যসম্পদের বড় প্রজনন ক্ষেত্র। চরমেঘায় অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপিত হলে সেখানে গড়ে উঠবে শিল্প-কারখানা। এর বিরূপ প্রভাব মেঘনার মৎস্যসম্পদের ওপর পড়বে’। এর বেশী কিছু বলতে অপরাগতা জানান তিনি।
অর্থনৈতিক জোন হলে ক্ষতির ধরন বর্ণনা করতে গিয়ে মৎস্য অধিদপ্তরের এক মাঠ কর্মকর্তা বলেন, ‘মুরগী ডিম দেয়ার জন্য গৃহস্থলির ঘরের কোনে নির্জন স্থানটি বেছে নেয়। ঠিক তেমনি ইলিশসহ অন্যান্যও মাছ প্রজনের জন্য নদীর নির্জন এলাকা পছন্দ। চরমেঘা সংলগ্ন মেঘনা তেমনই একটি নির্জন নদী। প্রজনের জন্য মা মাছ গত কয়েকবছরে এ এলাকাটি বেছে নিয়েছে। সেখানে অর্থনৈতিক জোন হলে শিল্প-কারখানায় এলাকাটি কর্মমুখর হবে। কলকারখানার বর্জ্য পড়বে নদীতে। মেঘনার পানি উঞ্চ হবে। দিনরাত চলাচল করবে পণ্যবাহি নৌযান। সবমিলিয়ে নির্জনতা হারিয়ে মৎস্যপ্রাণীকুল গতিপথ পরির্তন করে ফেলবে’। এ কর্মকর্তার মতে, অর্থনৈতিক জোনে বড়জোর ২০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে, অপরদিকে জেলেসহ মৎস্য সংশ্লিস্ট পেশার লক্ষাধিক মানুষ কর্ম হারাবে।
বেজার দায়িত্বশীল সুত্রে জানা গেছে, ২০৩০ সালের মধ্যে দেশে মোট ১০০টি অর্থনৈতিক স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বেজা। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২০ সালের আগস্টে বেজার গর্ভনিং বোর্ডের সভায় হিজলার চরমেঘাসহ দেশের ১০ স্থানে ১০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল অনুমোদিত হয়।
চরমেঘার পরিচয় : গৌরবদী ইউনিয়নের পাশ দিয়ে প্রবাহিত মেঘনার মাঝে প্রায় ৩০ বছর আগে জেগে ওঠা চরটির নাম চরমেঘা। মুলভূখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন দূর্গম চরটি ইউনিয়নের ৯ নং ওয়ার্ডভূক্ত। ইউপি সদস্য জাহিদ হোসেন জানান, চরের উত্তর, দক্ষিন ও পশ্চিম দিকে বিশাল মেঘনা। পূর্বদিকে মেঘনার শাখা চ্যানেল। চ্যানেলটির অপর তীর লক্ষীপুর জেলার সদর উপজেলা। জাহিদ হোসেন আরও জানান, গৌরবদী ইউনিয়নের মুলভূখন্ড থেকে চরমেঘায় পৌছতে ট্রলারে ৫০ মিনিট সময় লাগে। চরের পূর্ব দিকের চ্যানেলটি ট্রলারে ১৫ মিনিট পাড়ি দিলে লক্ষীপুরে পৌছানো যায়। সে কারনে বরিশাল জেলার ভুখন্ডের মধ্যে অর্থনৈতিক জোন হলেও এটির সুবিধাভোগী হবেন লক্ষীপুর-নোয়াখালীর লোকজন।
বরিশালের মৎস্য কর্মকর্তা (ইলিশ) বিমল চন্দ্র দাস বলেন, মেঘনার ষষ্ঠ অভয়াশ্রম তিনভাগে বিভক্ত, যার সীমানা হলো বরিশালের চরমোনাইর হবিনগর পয়েন্ট থেকে মেহেন্দিগঞ্জের বামনীরচর পর্যন্ত ১৩ দশমিক ৭ বর্গকিলোমিটার। বামনীরচর থেকে হিজলার লঞ্চঘাট পর্যন্ত ৮ দশমিক ৮১ বর্গকিলোমিটার এবং হিজলার লঞ্চঘাট থেকে মেহেন্দিগঞ্জের জাঙ্গালিয়া পর্যন্ত ৫৯ দশমিক ৪৯ বর্গকিলোমিটার। ৫৯ দশমিক ৪৯ বর্গকিলোমিটারের মধ্যেই মেঘনার বিষকাঠির চরপয়েন্ট থেকে চরমেঘার অবস্থান। হিজলা, ভোলা ও চাঁদপুর থেকে প্রবাহিত মেঘনার মিলনস্থল হলো চরমেঘার মোহনা। চরমেঘার তিন পাশ দিয়ে মেঘনা বয়ে গেছে। সারাবছরই সেখানে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ে। এসব এলাকা হলো ইলিশের খনি।
চরমেঘায় অর্থনৈতিক অঞ্চল কেন? : চরমেঘার ২ হাজার ২৫৫ দশমিক ৯৬ একর খাসজমিতে নেই জনবসতি। এখানে অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপিত হলে ভূমি অধিগ্রহন কিম্বা পুনর্বাসন ব্যয় হবেনা। নদীপথের বিষয়টি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের জন্য এর আগে আগৈলঝাড়া উপজেলার পয়সারহটে ৩০০ একর জমি দেখে বেশ অগ্রগতি হলেও শেষ মুহুর্তে নিচু জমি ভরাট ও অধিগ্রহন ব্যয় দেখিয়ে বেজা পিছু হটে। পরে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের উজিরপুরের জয়শ্রীতে ২০০ একরের আরেকটি জমি পছন্দের পরও একই কারন দেখায় বেজা। এরপরেই স্থানীয় এক শীর্ষ জনপ্রতিধির মাধ্যমে বেজার চোখ পড়ে চরমেঘায়।
বিশেষজ্ঞরা যা বললেন : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্যবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যপক ড. ইয়ামিন হোসেন হিজলার চরমেঘায় অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের সিদ্ধান্ত মৎস্যসম্পদের জন্য ‘ভয়ংকর’ ক্ষতি বলে আখ্যা করেছেন। তিনি ২০১৯ সাল থেকে বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে “ষ্টক অ্যাসেসমেন্ট অব কর্মাশিয়ালি ইনপরটেন্ট ফিসেশ ইন দ্যা বে অব বেঙ্গল” নামক গবেষক দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। প্রায় ২০ বছর আগে প্রথম চাকুরীজীবনে তিনি হিজলা উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা ছিলেন। যে কারনে মেঘনার মৎস্যসম্পদ নিয়ে তার ধারনাও ব্যাপক।
ড. ইয়ামিন বলেন, হিজলা-মেহেন্দিগঞ্জের পাশ দিয়ে প্রবাহিত মেঘনা মাছের প্রজনন উপযোগী নির্জন নদী। এ কারনে ওই অঞ্চলে শুধু ইলিশ নয়, ‘ক্যাটফিস’ প্রজাতির মাছ যেমন- পাঙ্গাস, আইড়, বোয়াল মাছেরও বড় প্রজননক্ষেত্র। তাছাড়া ক্যাটফিস প্রজাতির মাছের প্রধান খাবার হচ্ছে ইলিশের ডিম। এই ডিমের লোভে বিভিন্ন নদীর ক্যাটফিস মেঘনায় ছুটে আসে।
ড. ইয়ামিন বলেন, চরমেঘায় অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠন হলে সেখানে ইট-পাথরের স্থাপনা গড়ে ওঠবে। বিদ্যুৎ উৎপাদন ও শিল্পের রাসয়নিক ক্যামিক্যাল, প্লাষ্টিক পলিথিন সবকিছুই পড়বে মেঘনায়। কর্মমুখর মানুষের কোলাহল বাড়বে। মানবসৃষ্ট দুষনের কবলে পড়বে নদী। ফলে মেঘনায় ইলিশসহ মৎস্য প্রজননের বড় ক্ষেত্রটি নিশ্চিত বিনাশ হয়ে যাবে।
উদহারন হিসাবে ড. ইয়ামিন বলেন, যমুনা সেতুর টাঙ্গাইল প্রান্তে আগে রুই, কাতল ও মৃগাল মাছের প্রজননক্ষেত্র ছিল। সেতু স্থাপনের তা হারিয়ে গেছে।
চাঁদপুর ইলিশ গবেষনা কেন্দ্রের মূখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আনিছুর রহমান অভিন্ন মত দিয়ে বলেন, অর্থনৈতিক অঞ্চলে শিল্পায়ন হলে তার বর্জ্য নদীতে নির্র্র্গত হয়ে পানি দূূূষিত হবে। এতে শুধুু মাছ নয়, নদীর জীববৈচিত্র ক্ষতিগ্রস্থ হবে। শিল্প অঞ্চল স্থাপনের আগে এনভায়রোমেন্ট ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট (ইআইএ) করে ক্ষতির বিষয়টি নিরূপন করা উচিত।
ক্ষুদ্ধ নাগরিক সমাজ : বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের বরিশালের সমম্বয়ক রফিকুল আলম বলেন, চরমেঘা নিয়ে অনেক তামাশা চলছে। প্রথমে সেখানে ইকোপার্ক, তারপরে বিদুৎকেন্দ্র, এখন আবার অর্থনৈতিক জোন করার পায়তারা চলছে। মাছের প্রজনন এলাকায় কোন কিছু করার অর্থ হবে নদীর জীববৈচিত্র ধ্বংস করে দেয়া। রফিকুল আলম বলেন, পদ্মা ও পায়রা সেতুর কারনে দক্ষিণাঞ্চলে অর্থনৈতিক বিকাশ ঘটবে। তার আগে পরিবেশ, কৃষি ও নদীর ক্ষতির বিষয়গুলো চিহিৃত ও এনিয়ে গণশুনানী করে উন্নয়ন জোন ভাগ করে দেয়ার জন্য তারা জেলা প্রশাসককে বলেছেন। নদী-পরিবেশ ধ্বংস হবে এমন কোন কিছু আমরা কোনভাবেই মেনে নেবনা। রফিকুল আলম বলেন, আমলা-এমপিরা নেতিবাচক প্রভাবগুলো বিবেচনায় না এনে লুটপাটের আশায় তরিঘড়ি করে প্রকল্প তৈরী করেন। পরে তার খেসারত দিতে হয়। পায়রা সমুদ্র বন্দর ও পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে স্থাপনে ‘স্থান নির্বাচনে’ ভুল সিদ্ধান্তের খেসারত দিতে হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন রফিকুল আলম।
বরিশাল জেলার উন্নয়ন, পরিবেশ, ও ঐতিহ্য সুরক্ষা কমিটির সদস্য সচিব শিক্ষাবিদ অধ্যক্ষ মহসিন উল ইসলাম হাবুল বলেন, হিজলা-মেহেন্দিগঞ্জ ও মুলাদী উপজেলা এবং ভোলা জেলার বড় একটি জনগোষ্ঠী মেঘনায় মাছ আহোরন করে জীবিকা নির্বাহ করে। অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন উপযোগী দক্ষিণাঞ্চলে হাজার হাজার একর খাসজমি আছে। মৎস্যসম্পদের ক্ষতি করে চরমেঘায় অর্থনৈতিক অঞ্চল করতে দেয়া হবেনা। প্রয়োজনে এর বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামা হবে।
জাতীয় ক্ষুদ্র জেলে সমিতির কেন্দ্রীয় সাধারন সম্পাদক আনোয়ার হোসেন সিকদার বলেন, মোহনায় চর পড়ে নাব্য সংকট সৃষ্টি হওয়ায় সাগর থেকে নদীতে ইলিশ আসছেনা। বরগুনার পায়রার মোহনায় তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করার পর ওই এলাকার নদীগুলোতে ইলিশসহ অন্যান্য মাছ পাওয়া যাচ্ছেনা। হাজার হাজার জেলে বেকার হয়ে পড়েছেন। মেঘনায় অর্থনৈতিক অঞ্চল একই পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। সরকার এসব বিবেচনায় না আনলে জেলেরাও আন্দোলনে নামবে।##

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *