পীরগঞ্জে হিন্দুপল্লীতে হামলা, স্বীকারোক্তীতে যা বললো সৈকত-রবিউল

Spread the love

নাগরিক ডেস্ক : রংপুরের পীরগঞ্জের বড় করিমপুরে হিন্দু ধর্মাবলম্বী পরিতোষ সরকার ও মুসলিম উজ্জ্বলের ব্যক্তিগত বিরোধ ছিল। এর জের ধরে এই দুই তরুণ ফেসবুকের ম্যাসেঞ্জারে তর্কে জড়ান। পরিতোষের ধর্ম নিয়ে উজ্জ্বল কটূক্তি করেন। পরিতোষ এর জবাবে উজ্জ্বলের ধর্ম নিয়ে পাল্টা মন্তব্য করেন। পরিতোষের ওই মন্তব্য ফেসবুকে পোস্ট করেন উজ্জ্বল। উজ্জ্বলের ওই পোস্ট সৈকত মণ্ডল নামের আরেক তরুণ তাঁর নিজস্ব ফেসবুক পেজে ছড়িয়ে দেন।

সম্প্রতি কুমিল্লায় অপ্রীতিকর ঘটনার পর ফেসবুকে বিভিন্ন মন্তব্য করেন সৈকত। শেষে উজ্জ্বলের পোস্টকে কেন্দ্র করে শুরু অপপ্রচার। ফেসবুকে তিনি লেখেন, ‘এই মুহূর্তে গ্রাম পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া সংবাদ, হিন্দুদের আক্রমণে এক মুসলিমকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে।’ এই পোস্টের পর পীরগঞ্জের হিন্দুপল্লীর কাছে একটি মসজিদ থেকে মাইকিং করেন তিনি। সেখানে উত্তেজিত হয়ে কিছু লোক জড়ো হলে মসজিদের ইমাম রবিউল ইসলাম মাইকে উসকানিমূলক বক্তব্য দিতে থাকেন। ওই সময় সৈকত ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে উত্তেজনাকর বক্তব্য দিয়ে হামলায় নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করেন।

ঘটনার প্রধান হোতা সৈকত মণ্ডলকে গ্রেপ্তারের পর র‌্যাব এসব তথ্য জানিয়েছে। গত শুক্রবার গাজীপুরের টঙ্গী থেকে সৈকত মণ্ডল (২৪) ও সহযোগী রবিউল ইসলামকে (৩৬) গ্রেপ্তার করে র‌্যাব-১৩ ও সদর দপ্তরের গোয়েন্দাদল। এ নিয়ে পীরগঞ্জের ঘটনায় ৬০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ ও র‌্যাব। তাঁদের মধ্যে চারজন আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন।

আসামিদের বরাত দিয়ে তদন্তকারীরা বলছেন, কুমিল্লার ঘটনার পর ফেসবুকে গুজব ছড়িয়ে এবং মসজিদের মাইকে উসকানি দিয়ে পীরগঞ্জে হামলার ঘটনাটি ঘটে। সৈকত মণ্ডল, রবিউল, উজ্জ্বলসহ কয়েকজন পরিকল্পিতভাবে এই হামলার ক্ষেত্র তৈরি করেন। তাঁদের কয়েকজন হামলার সময় হিন্দুদের বাড়িতে লুটপাটও করেন।

মূল পরিকল্পনাকারী সৈকতের কোনো রাজনৈতিক পরিচয় পাওয়া যায়নি বলে দাবি করেছে র‌্যাব। তাঁরা বলছেন, এক কলেজে পড়লেও অন্য কলেজের নেতা বলে পরিচয় দেন তিনি। এভাবে ফেসবুকে ভুয়া আত্মপ্রচার চালাতেন সৈকত। তবে স্থানীয়রা জানিয়েছেন, সৈকত আগে ছাত্রশিবিরের কর্মী ছিলেন। কারমাইকেল কলেজের ছাত্রলীগে যোগ দিয়ে দর্শন বিভাগ শাখার সহসভাপতির পদও পান তিনি। বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য তাঁকে গত ১৮ অক্টোবর বহিষ্কার করা হয়েছে।

গতকাল শনিবার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, কুমিল্লার ঘটনার পর থেকেই সৈকত নানা উসকানিমূলক পোস্ট দিচ্ছিলেন। পরিতোষ ও উজ্জ্বলের দ্বন্দ্বের ঘটনাকে সুযোগ হিসেবে নিয়েছিলেন সৈকত। র‌্যাব পরিচালক বলেন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করতে একটি নাজুক সময়ের জন্য অপেক্ষা করছিলেন সৈকত। পরিতোষের বার্তাকে কেন্দ্র করে সৈকত উসকানি ছড়ানোর পাশাপাশি নেতৃত্ব দিয়ে হামলার ঘটনা ঘটিয়েছেন।

কী উদ্দেশ্যে উসকানিমূলক পোস্ট দিয়েছিলেন সৈকত জানতে চাইলে কমান্ডার মঈন বলেন, তাঁর (সৈকত) ফেসবুক পেজে প্রায় তিন হাজার ফলোয়ার রয়েছে। সেটিকে কাজে লাগিয়েছেন তিনি।

সৈকত মণ্ডল ছাত্রলীগের কোনো পদে ছিলেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সৈকত রংপুরের একটি ডিগ্রি কলেজের শিক্ষার্থী। রংপুরে ছাত্রলীগের নেতা হিসেবে নিজে প্রচার করতে পারেন কিন্তু তাঁর কোনো রাজনৈতিক পদ-পদবি আমরা পাইনি।’

প্রশ্নের জবাবে র‌্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, গ্রেপ্তার সৈকত প্রথমে পাশের মসজিদ থেকে মাইকিং শুরু করেন। এরপর তিনি মাইকিংয়ের দায়িত্ব রবিউলকে দিয়ে উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে হামলার নেতৃত্ব দেন। মাইকিংয়ের ভাষা ছিল এমন—‘পরিতোষ নামের ছেলেটি ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছে কাবাঘর অবমাননা করে; এলাকাবাসী ও তৌহিদি জনতা একত্র হন।’

শিবিরের যোগসাজশ : স্থানীয়রা জানান, সৈকত মণ্ডল কারমাইকেল কলেজে গিয়ে ছাত্রলীগ করলেও আগে তিনি ছাত্রশিবিরের রাজনীতি করতেন। এলাকায় জামায়াত ও ছাত্রশিবিরের লোকজনের সঙ্গে তাঁর চলাফেরা ছিল।

সৈকতের বাবার নাম রাশেদুল ইমলাম। তাঁর বাড়ি রামানাথপুর ইউনিয়নের চেরাগপুর গ্রামে। তিনি কারমাইকেল কলেজের দর্শন বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র। ছাত্রলীগের দর্শন বিভাগ শাখার সহসভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। হামলার পরদিন ১৮ অক্টোবর শৃঙ্খলা পরিপন্থী কার্যকলাপে জড়িত থাকার অভিযোগে তাঁকে ছাত্রলীগের কারমাইকেল কলেজ শাখা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। ছাত্রলীগের কারমাইকেল কলেজ শাখার সভাপতি সাইদুজ্জামান সিজার ও সাধারণ সম্পাদক জাবেদ আহমেদ স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

কারমাইকেল কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি সাইদুজ্জামান সিজার বলেন, ‘সৈকত আগে থেকেই ফেসবুকে উসকানিমূলক পোস্ট দিয়ে আসছিল। সর্বশেষ পীরগঞ্জের ঘটনাটি আমাদের নজরে আসায় মহানগর ছাত্রলীগের পরামর্শক্রমে তাকে বহিষ্কার করা হয়।’

রবিউল মসজিদের ঈমাম : স্থানীয়রা জানান, যে মসজিদ থেকে মাইকিং করা হয় গ্রেপ্তারকৃত রবিউল ইসলাম সেই মসজিদেরই ইমাম। তিনি একই এলাকার খেজমতপুর গ্রামের মোসলেম উদ্দিনের ছেলে। প্রায় ১২ বছর থেকে তিনি ওই মসজিদে ইমামের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। তিনি বটেরহাট মাদরাসা থেকে দাখিল ও দুরামিঠিপুর আলিম মাদরাসা থেকে আলিম পাস করেন। মাদরাসায় পড়ার সময় তিনি জামায়াতের রাজনীতিতে যুক্ত হন। রবিউল ইসলাম ঘটনার দিন মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে সবাইকে একত্র হতে বলেন। তাঁর ঘোষণার পরই অসংখ্য মানুষ একত্র হয়ে মাঝিপাড়ায় হামলা চালায়। হামলায় রবিউল ইসলাম নিজেও অংশ নেন।

এদিকে পুলিশের তদন্তে পীরগঞ্জের বড় করিমপুর কসবা এলাকার মাঝিপাড়ার হিন্দুপল্লীর ২৫ পরিবারের স্বর্ণালংকার, লক্ষাধিক টাকা, ৩০টি গরু, ছয়টি ছাগল লুট হওয়ার তথ্য মিলেছে। এর মধ্যে ছয়টি ছাগল ও একটি এলইডি টিভি উদ্ধার করেছে পুলিশ।

পীরগঞ্জ থানার ওসি সরেষ চন্দ্র বলেন, ফেসবুকে অবমাননাকর ছবি পোস্ট দেওয়া এবং হামলার ঘটনায় তিনটি মামলায় শুক্রবার পর্যন্ত ৫৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পরিতোষ, উজ্জ্বল, আল আমিন ও আব্দুর রাজ্জাক নামের চারজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। আসামিরা উসকানিতে হামলা এবং লুটপাটের ব্যাপারে স্বীকার করেছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *