পচাত্তরের ১৫ আগষ্ট আ.স.ম ফিরোজ কি বঙ্গবন্ধু ছবি পদাদলিত করেছিলেন?

Spread the love

নাগরিক রিপোর্ট : পচাত্তরের ১৫ আগষ্ট ট্রাজেডির দিন আ.স.ম ফিরোজ আনন্দ মিছিল করে তৎকালীন বরিশাল শহরে আওয়ামীলীগ কার্যালয়ে হামলা-ভাংচুর ও বঙ্গবন্ধুর ছবি পদদলিত করেছেন’- বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর বরিশালে আওয়ামীলীগের কয়েকজন নেতার এ অভিযোগটি এতদিন মুখে মুখেই সীমাবদ্ধ ছিল। তখনকার ছাত্রলীগ নেতা আ.স.ম ফিরোজ এরইমধ্যে পটুয়াখালী- ২ (বাউফল) আসনে আওয়ামীলীগের মনোনয়নে ৭ বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন, ছিলেন বিগত সংসদের চিফ হুইপ।
উল্লেখিত অভিযোগে গত মঙ্গলবার পটুয়াখালী আদালতে আ.স.ম ফিরোজের বিরুদ্ধে বাউফল সদর ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের শ্রম বিষয়ক সম্পাদক মো. জাহিদুল হক (৪৬) মামলার আবেদন করলে পুরানো অভিযোগটি নতুন করে সামনে এসেছে। কাল রোববার আদালত এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবেন। তবে ৪৬ বছর আগের বিষয়টি কারা কি উদ্দেশ্যে নতুন করে সামনে আনলো এনিয়ে চলছে নানামুখী আলোচনা।
১৯৭৫ কালীন সময়ে বরিশালে রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিম্বা রাজনৈতিক খোঁজ রাখতেন এবং বর্তমানে বাউফলে আওয়ামীলীগের সক্রিয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঘটনা সত্য-মিথ্যা যাই হোক, সম্প্রতি দায়ের হওয়া মামলার নেপথ্যে রয়েছে দলের অভ্যন্তরীন বিরোধ। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বরিশালে আওয়ামীলীগের দুটি গ্রুপের একপক্ষে সক্রিয় ছিলেন তখনকার তুখোর ছাত্রলীগ নেতা আ.স.ম ফিরোজ। আবার বর্তমানে বাউফলে তিনভাগে বিভক্ত আওয়ামীলীগের একটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি। ‘৭৫ ট্রাজেডির পর তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা এবং মঙ্গলবার মামলার আবেদন দুটি ঘটনাই ঘটেছে প্রতিপক্ষ শিবির থেকে। এর সঙ্গে জড়িয়েছে আগামী জাতীয় নির্বাচনে বাউফল আসনে মনোয়নেরও হিসেব-নিকেশও।
পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার কালাইয়া গ্রামের সন্তান আ.স.ম ফিরোজ ছাত্রলীগের রাজনীতি করেছেন দক্ষিণাঞ্চলের তৎকালীন প্রধান শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ব্রজমোহন (বিএম) কলেজে। ১৯৬৯-৭০ সালে তিনি ছাত্র সংসদের (বাকসু) নির্বাচিত ভিপি ছিলেন। পরে পটুয়াখালী- ২ (বাউফল) আসনে ১৯৭৯ সালে আওয়ামীলীগের (মিজান) মনোনয়নে এবং ‘৮৬, ৯১, ৯৬, ২০০৮, ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে আওয়ামীলীগ মনোনীত এমপি নির্বাচিত হন।
কি ঘটেছিল সেদিন বরিশালে
আ.স.ম ফিরোজের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে সবচেয়ে বেশী সরব কৃষকলীগের কেন্দ্রীয় সদস্য ও ‘৬৮ সালের বাকসু ভিপি খান আলতাফ হোসেন ভুলু। বুধবার আদালতে করা মামলার আবেদনে দ্বিতীয় স্বাক্ষী তিনি। ‘৭৫ সালে বরিশাল জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। মামলার ১ নম্বর স্বাক্ষী তখনকার বরিশাল জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ও বর্তমান আওয়ামীলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক। খান ভুলু বলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার প্রতিবাদ ও খুনীদের বিচারে দাবীতে তার নেতৃত্বে মিছিল বের হয়। খুনী মোশতাকের পক্ষ নেন তৎকালীন জেলা আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক ও বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রী পরিষদের প্রতিমন্ত্রী নুরুল ইসলাম মঞ্জু (জেল হত্যা মামলায় অভিযুক্ত আসামী)। মিছিলটি সদর রোড বিবির পুকুর পাড়ে পৌছলে মঞ্জুর দোসর আ.স.ম ফিরোজের নেতৃত্বে ৮-১০ জন বগুরা রোড থেকে বের হয়ে হামলা করে। পরে হামলাকারীরা আওয়ামীলীগ কার্যালয় ভাংচুর ও বঙ্গবন্ধুর ছবিতে জুতা ঝুলিয়ে আনন্দ-উল্লাস করেছে। একইভাবে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ও বিএম কলেজসহ বিভিন্ন সরকারী দপ্তরেও বঙ্গবন্ধুর ছবি ভাংচুর করা হয়।
তবে এ বিষয়ে ভিন্নমত দিয়েছেন নগরীর বাসিন্দা এক বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ঘটনাস্থলের অদুরে অশ্বিনী কুমার হলের দোতালায় দাঁড়িয়ে ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন দাবী করে বলেন, ‘অশ্বিনী কুমার হল লাগোয়া বর্তমানে সসন্ত্র বাহিনীর অফিসটি (দোতালা ভবন) ছিল আওয়ামীলীগ কার্যালয়। বেলা ১১টার দিকে দুটি ট্রাকে লঞ্চঘাটের একদল শ্রমিক শ্রমিক এসে কার্যালয়টি হামলা-ভাংচুর করে। ছট্রু নামক এক শ্রমিক নেতা ছিলেন তাদের নেতৃত্ব। আওয়ামীলীগ কার্যালয় ভবনের উত্তর দিকে প্রাচীরের বাইরে (কাটপট্রি যাওয়ার সড়কে) তিনটি টিনের ঘর এখনও বিদ্যমান। মাঝের ঘরটিতে স্বপরিবারে থাকতেন আ.স.ম ফিরোজ। ভাংচুরকারীরা চলে যাওয়ার পর তিনি বাসা থেকে বের হয়ে ঘটনাস্থল প্রত্যক্ষ করেন। এ বক্তব্য সমর্থন করে সদর রোডের বাসিন্দা আরেক মুক্তিযোদ্ধা বলেন, সদর রোড গুলবাগ হোটেলে দাড়িয়ে তিনি ঘটনা দেখেছেন। লঞ্চঘাট শ্রমিকরা ভাংচুর করলেও আ.স.ম ফিরোজকে শারীরিকভাবে দেখা যায়নি। দুই মুক্তিযোদ্ধাই দাবী করেন, ১৫ আগষ্ট বরিশালে আনন্দ কিম্বা প্রতিবাদ মিছিল কিছুই হয়নি। আ.স.ম ফিরোজ আওয়ামীলীগের দুই গ্রুপের দ্বন্দ্বের পরিস্থিতির শিকার ছিলেন।
তখনকার রাজনৈতিক সচেতনদের একাধিকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে ১৫ আগষ্টের আগ পর্যন্ত বরিশালে আওয়ামীলীগের দুটি গ্রুপ ছিল প্রকাশ্যে। একটির নেতৃত্বে ছিলেন জেলা সভাপতি অ্যাডভোকেট মালেক খান ও সাধারন সম্পাদক প্রতিমন্ত্রী নুরুল ইসলাম মঞ্জু। বঙ্গবন্ধু ভাগ্নে তখনকার কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রব সেরনিয়াবাতকে (১৫ আগষ্ট শহীদ) ঘিরে ছিল আওয়ামীলীগের আরেকটি শক্তিশালী বলয়। মালেক-খান মঞ্জু গ্রুপের সক্রিয় ও গুরুত্বপূর্ন ভূমিকায় ছিলেন আ.স.ম ফিরোজ।
এ সসব বিষয়ে বক্তব্য জানতে আ.স.ম ফিরোজের মুঠোফোনে কল দেয়া হলে বন্ধ পাওয়া গেছে। গত মঙ্গলবার মামলা দায়েরের পর তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘৭০’র দশকে যারা বিএম কলেজে ছাত্ররাজনীতিতে আমার সঙ্গে পেরে উঠতে পারেননি তারাই এসব মিথ্যচার ছড়াচ্ছেন। আমি কি করেছি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সব জানেন। তিনি আমাকে বিশ্বাস করেন। আমাকে বার বার দলীয় মনোনয়ন দিয়েছেন ও চিফ হুইপ করেছেন। ষড়যন্ত্রকারীরা আগে সফল হতে পারেনি, এখনও পারবেন না’।
বিরোধ যখন বাউফলে
১৫ আগষ্ট ট্রাজেডির পর আ.স.ম ফিরোজ পটুয়াখালী- ২ (বাউফল) আসন ভিত্তিক রাজনীতি শুরু করেন। ২০০১ সাল পর্যন্ত বাউফল আওয়ামীলীগ ছিলো তার একক নিয়ন্ত্রনে। ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে এ আসনে দলের মনোয়ন দাবী করে পৃথক বলয় তৈরী করেন শিল্পপতি ও মার্কেন্টাইল ব্যাংকের পরিচালক এস.এম ফিরোজ। শেষ পর্যন্ত আ.স.ম ফিরোজ নৌকা প্রতীক পেলেও চারদলীয় জোট প্রার্থীর কাছে পরাজিত হন। ২০০৮ সালে আবার সংসদ নির্বাচিত হলেও ২০১২ সালে পৌর নির্বাচনে আরেকদফা হোচট খান। তার মনোনীত প্রার্থী গোলাম কিবরিয়া পান্নুকে পরাজিত করে মেয়র নির্বাচিত স্বেচ্ছাসেবকলীগের কেন্দ্রীয় নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী জিয়াউল হক জুয়েল। তাকে ঘিরে বিরোধীরা নতুন করে সংগঠিত হলে শক্ত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েন আ.স.ম ফিরোজ। প্রতিটি ইউনিয়ন-ওয়ার্ড পর্যায়ে আওয়ামীলীগ দুইভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। রক্তাক্ত সংঘর্ষে দুইপক্ষে এ পর্যন্ত নিহত হয়েছেন ৭ জন। ২০১৯ সালের উপজেলা নির্বাচনে মেয়র সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীকে পরাজিত করে চেয়ারম্যান হন এমপি ফিরোজের ৩ যুগের অস্থাভাজন উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক মোতালেব হাওলাদার। এরপরেই মোতালেব হাওলাদারের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হতে থাকে এমপি ফিরোজের। গত ৬ মাস যাবত উপজেলা চেয়ারম্যান ও আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক মোতালেব মোতালেব হাওলাদার আরেকটি বলয় নিয়ে সাংসদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়েছেন। স্বাধীনতার সুবর্নজয়ন্তী পালনে এমপি ফিরোজ বুধবার, মোতালেব হাওলাদার ও মেয়র জুয়েল বৃহস্পতিবার পৃথক ৩টি বড় শোডাউন করেছেন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মোতালেব হাওলাদার  বলেন, এমপি ফিরোজের কল্যানে আমি ৩ বার বগা ইউনিয়ন চেয়ারম্যান, ৩ মেয়াদ উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক ও উপজেলা চেয়ারম্যান হই। আড়াইবছর আগে উপজেলা চেয়ারম্যান হওয়ার পরই এমপি ফিরোজ আমাকে অন্যভাবে দেখা শুরু করেন। নেতাকর্মীদের আমার কােেছ আসতে নিষেধ করেন এবং তাদের বলেন, ‘মোতালেবের পাখা গজাইছে’। উন্নয়ন বরাদ্ধ বন্ধ করে দেন। এর আগেও অনেক ত্যাগী কর্মীকে এমপি দল থেকে বিদায় করেছেন। আমার একই পরিনিতি হবে বুঝতে পেরে আমি নিজেই তার কাছ থেকে দুরে সরে যাই’। এমপি বিরুদ্ধে দূর্ণীতিরও অভিযোগ করেন উপজেলা চেয়ারম্যান মোতালেব। বঙ্গবন্ধুর ছবি ভাংচুরসহ এতসব অভিযোগ থাকার পরও তিনযুগ কেন আ.স.ম ফিরোজ এমপির ঘনিষ্টজন ছিলেন জানতে চাইলে মোতালেব হাওলাদার বলেন- ‘আমি লজ্জিত’। স্থানীয় সুত্র জানিযেছে, আ.স.ম ফিরোজের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশী সুবিধাভোগী মোতালেব হাওলাদার গত মেয়াদে তার স্ত্রীকে উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ও ছেলেকে বগা ইউনিয়নে দুইবার চেয়ারম্যান নির্বাচিত করেছেন।
আলোচনায় জাহিদ হোসেন : বাউফল সদর ইউনিয়ন আওয়ামীলগের শ্রম বিষয়ক সম্পাদক তিনি। উপজেলা চেয়ারম্যান মোতালেব হাওলাদারের অনুসারী হিসাবে পরিচিত। আ.স.ম ফিরোজের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ নিয়ে মামলা করতে তিনি কেন উৎসাহী জানতে চাইলে জাহিদ বলেন, ‘‘গত ৯ ডিসেম্বর বেলা ১১টার দিকে উপজেলা আওয়ামীলীগ কার্যালয়ে দম্ভ করে বলেছেন, আমি বঙ্গবন্ধুর ছবি ভেঙ্গেছি, আরও অনেক কিছু করেছি, তাতেই আমার কিছু হয়নাই, তার বিরোধীতাকারীরাও কিছু করতে পারবেন না’। ওই কথা শুনে বঙ্গবন্ধুর কর্মী হিসাবে আমার (জাহিদ) মনে আঘাত লাগায় আমি আদালতে মামলার আবেদন করেছি। উপজেলা চেয়ারম্যান মোতালেব হাওলাদার বলেন, তিনি জাহিদকে চেনেন, তার মামলা করার বিষয়ে কিছু জানেন না। ##

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *