পাথরঘাটা মৎস্য মোকামে চাঁদাবাজীতে অতিষ্ট জেলে-পাইকাররা মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছেন

Spread the love

নাগরিক রিপোর্ট : বরগুনার পাথরঘাটার স্থায়ী বাসিন্দা ট্রলার মালিক ও জেলে ইলিয়াস (ছদ্মনাম) একযুগের বেশী সময় সাগরে মাছ ধরে পাথরঘাটা মৎস্য অবতরন কেন্দ্রে (বিএফডিসি) বিক্রি করে আসছেন। গত বছরের মধ্যভাগ থেকে ইলিয়াস সুযোগ পেলেই মাছ বিক্রি করছেন বাগেরহাট মৎস্যকেন্দ্রে। ইলিয়াস জানালেন, বাগেরহাটে মাছের দাম পাথরঘাটার চেয়ে বেশী পান না। তবে বিক্রিত টাকার পুরোটই তার পকেটে আসে। পাথরঘাটায় ১ লাখ টাকার মাছ বিক্রি করলে বিভিন্ন খাতে চাঁদা দিতেই খরচ হয় ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা।
ইলিয়াসের মতো শত শত জেলে এখন পাথরঘাটা বিএফডিসি থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছেন। তারা মাছ বিক্রির জন্য বিকল্প স্থান খুঁজে নিয়েছেন পটুয়াখালীর মহিপুর, বাগেরহাট, পিরোজপুরের পাড়েরহাটসহ বিভিন্ন মৎস্য মোকাম। জেলেদের অভিযোগ, পাথরঘাটা মোকামে চাঁদাবাজীর অত্যাচারে তারা অতিষ্ট।
একাধিক জেলে ও মৎস্য ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেপরোয়া চাঁদাবাজী ও সিন্ডিকেট ব্যবসার কারনে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মৎস্য অবতরন কেন্দ্র পাথরঘাটা বিএফডিসিতে বানিজ্যে এখন ধ্বংসের পথে। আড়তদার সমিতি, মৎস্য শ্রমিক ইউনিয়ন ও পাইকার সমিতি- এই তিন সংগঠনের নামে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা চাঁদাবাজী হয়। উপজেলা আওয়ামীলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা ওই তিন সংগঠনের শীর্ষ পদে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
একাধিক জেলের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাগর থেকে মাছ বোঝাই ট্রলার বিএফডিসি ঘাটে পৌছলেই তিন সংগঠনের প্রতিনিধিরা দফায় দফায় বিভিন্ন খাতের চাঁদা আদায় করেন। নগদ টাকার সঙ্গে মাছও নিয়ে যান। পাইকারদের সিন্ডিকেটের কারনে ন্যার্য্য দাম পাচ্ছেন না জেলেরা। আবার ক্রয় করা মাছ সড়কপথে দেশের অন্যান্য এলাকায় পাঠাতে মাত্র একটি পরিবহন ট্রান্সপোর্টের কাছে জিম্মি পাইকাররা। এমন নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতে মোকামে মাছের ট্রলার আসা আগের তুলনায় অর্ধেকে কমে গেছে, দুরদুরান্ত থেকে পাইকার আসা প্রায় বন্ধের পথে। এমন পরিস্থিতির বিষয়ে জানতে চাইলে তিন সংগঠনের নেতারা একে অপরকে দায়ী করছেন।
পাথরঘাটায় মৎস্য মোকামের বর্তমান পরিস্থিতিতে হতাশা প্রকাশ করে প্রবীন এক মৎস্য ব্যবসায়ী বলেন, একবছর আগেও বিএফডিসিতে চাঁদাবাজীর একক নিয়ন্ত্রক ছিলো বহিস্কৃত শ্রমিকলীগ নেতা মোস্তাফিজুর রহমান সোহেলের হাতে। তাকে খুশী রাখতে পারলেই নিরাপদে ব্যবসা করতে পারতাম। চাঁদাবাজ দোহাই দিয়ে তাকে বিতারিত করে সেখানে শত চাঁদাবাজের আবির্ভাব হয়েছে। প্রঙ্গত, গতবছর জানুয়ারীতে পৌরসভা নির্বাচনে সোহেল মেয়র পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হলে এর জেরে তাকে উপজেলা শ্রমিলীগের সভাপতি পদ থেকে বহিস্কার ও তার আস্তানা গুড়িয়ে মোকামের নিয়ন্ত্রন নেয় প্রতিপক্ষরা।
পাথরঘাটা বিএফডিসির ব্যবস্থাপক ল্যাফট্যাননেস্ট লুৎফর রহমান এ বিষয়ে বলেন, বিএফডিসি অনুমোদিত আড়তদার, শ্রমিক ও পাইকারদের ৩টি সংগঠন রয়েছে। তার জানা মতে, এ সংগঠনগুলোর অভ্যন্তরীন বিরোধে মৎস্য মোকামে বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে। মোকামে মাছের আমদানী কমে যাওয়া এটিও একটি কারন হতে পারে। পাইকার আসাও কমে গেছে জাানিয়ে ল্যাফটনন্টে লুৎফর রহমান বলেন, তিনি শুনেছেন স্থানীয় পাইকাররাই চাচ্ছেন না দুরদুরান্তের পাইকাররা এসে এখানে ব্যবসা করুক। তাছাড়া সড়কপথে মাছ পরিবহনে একটি মাত্র ট্রান্সপোর্ট হওয়ায় কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। তিনি বিষয়গুলো স্থানীয় সংসদ সদস্য শওকত হাচানুর রহমান রিমনকে অবগত করেছেন।

চাঁদাবাজীর যত খাত : বিএফডিসিতে নিয়মিত মাছ বিক্রি করেন এমন ১০ জন জেলে ও ট্রলার মাঝির সঙ্গে কথা হয়েছে প্রতিবেদকের। সকলের অভিযোগ একই ধরনের। তারা বলেন, চাঁদার সবগুলো খাতই বহন করতে হয় জেলেদের। প্রতিটি ট্রলার ঘাটে ভেড়ানো হলে আড়তদার সমিতির নামে ১০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। কতটি ট্রলার মোকামে আসবে তা আগের রাতেই জেনে নেন পাইকাররা। তারা নিজেদের মধ্যে সমম্বয় করে মাছের দাম নির্ধারিত দরে মধ্যে আটকে দেন। ফলে কাংক্ষিত মূল্য পান না জেলেরা। বিক্রিত মূল্যের প্রতি লাখে ৫০০ টাকা দিতে হয় শ্রমিক ইউনিয়নের নামে। প্যাকেট করার জন্য প্রতি ককসিটে দিতে হয় ১০০ টাকা। আবার মাছ বিক্রির পর ইলিশ মাছে প্রতি লাখে ৪ হাজার টাকা এবং অন্যান্য মাছে ৫ হাজার টাকা পাইকারদের কম দেয়া হয়। হাঙ্গরসহ নিষিদ্ধ মাছ বিক্রিতে প্রতিমনে ৩ হাজার টাকা এবং জাটকা বিক্রিতে প্রশাসন ম্যানেজের নামে প্রতিমনে ১০০ টাকা চাঁদা নেয়া হয়। সাধারন মানুষ খুচরা মাছ কিনতে বিএফডিসিতে গেলে জন প্রতি ২০-২৫ টাকা করে নেয়া হয় শ্র্রমিক ইউনিযনের নামে। পাইকার সমিতির নামে প্রতি ককসিটে চাঁদা নেযা হয় ১০ টাকা।
এছাড়া ট্রলার মালিক সমিতির নামে প্রত্যেক ট্রলার থেকে ১০টি এবং শ্রমিক ইউনিয়নের নামে ৫টি করে ইলিশ মাছ নেয়া হয়। প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতাদের ম্যানেজ করার কথা বলে ট্রলার থেকে আড়তদার সমিতি। আড়তঘরের শ্রমিকরাও খাওয়ার কথা বলে প্রত্যেকে ১-২টি করে মাছ নেন। এভাবে চাঁদা হিসাবে একটি ট্রলার থেকে মাছই নেয়া হয় কয়েক হাজার টাকার।
পাইকাররা মাছ কেনার পর সড়কপথে সরবরাহের জন্য পাথরঘাটায় আগে দুটি ট্রান্সপোর্ট কোম্পানী থাকলেও এখন রাখা হয়েছে মাত্র একটি। এ প্রতিষ্ঠানের বেঁধে দেয় রেটেই মাছ পরিবহন করতে বাধ্য হন পাইকাররা।

অভিযুক্ত সংগঠন নেতারা যা বলেন : পাথরঘাটা বিএফডিসিতে নৈরাজ্য চলছে এবং এর প্রভাবে সেখানে বেচাকেনা অর্ধেকে নেমে গেছে এ কথা স্বীকার করেছেন পাইকার সমিতি ও শ্রমিক ইউনিয়ন নেতারা।
পাইকার সমিতির সভাপতি সাফায়াত হোসেন বলেন, বিএফডিসিতে যে নৈরাজ্য চলছে তাতে গুরত্বপূর্ন এ মৎস্য ব্যবসা কেন্দ্রটি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এর মুলে বেপরোয়া চাঁদাবাজী ও পরিবহন সেক্টরকে জিম্মি করে রাখাকে দায়ী করেছেন তিনি। স্থানীয় পাইকারদের বাঁধায় দুরের পাইকাররা আসছেন অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, পরিবহন ব্যবস্থা একটি মাত্র ট্রান্সপোর্ট কোম্পানীর জিম্মি থাকায় অন্য জেলার পাইকাররা পরিবহন সংকটের কারনে পাথরঘাটায় আসা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছেন।
অপরদিকে বিএফডিসি শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি ফারুক হোসেন দুরের পাইকার আসা বন্ধ হওয়ার জন্য পাথরঘাটার স্থানীয় পাইকারদের দায়ী করেন। তিনি বলেন, স্থানীয় পাইকাররা সিন্ডিকেট করে দুরের পাইকারদের মাছ কিনতে বাধাগ্রস্থ করতেন। ফারুকের দাবী, সম্প্রতি পাইকারদের সিন্ডিকেট ভেঙ্গে দেয়ায় দুরের কিছু সংখ্যক পাইকার আসা শুরু হয়েছে। স্থানীয়রা আড়তদারদের কাছে মাছের দাম বাবদ লাখ টাকা বকেয়া রাখেন। এ অজুহাতে আড়তদাররা বকেয়া রাখেন জেলেদের টাকা। যে কারনে জেলেরা ট্রলার নিয়ে পাথরঘাটা মোকামে আসছেন বলে জানান শ্রমিক সংগঠক ফারুক হোসেন।
বিভিন্ন জনের কথায় জানা গেছে, স্থানীয় এক শীর্ষ জনপ্রতিনিধির আশির্বাপুষ্ঠ হওয়ায় মোকামে এখন সবচেযে প্রভাবশালী হলেন আড়তদার সমিতির সভাপতি জাহাঙ্গীর জমাদ্দার। অপর দুই সংগনের নেতারা মোকামে চাঁদাবাজী ও নানা সংকটে মোকামে দুরবস্থা স্বীকার করলেও জাহাঙ্গীর জমাদ্দার বললেন, এসব কিছুই হয়না, সব মিথ্যা-অপপ্রচার। প্রতিমন ইলিশে পাইকারদের কাছ থেকে নেয়া ৪ হাজার টাকা আড়তদারী বলে দাবী করেন জাহাঙ্গীর। মোকামে মাছ আমদানী কম আসার কারন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, নদী-সাগরে বেশী ধরা পড়ছে জাটকা। কোষ্টগার্ড ও প্রশাসনের ভয়ে জাটকা নিয়ে ট্রলার চলে যাচ্ছে অন্য মোকামে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *