অভিযান- ১০ ট্রাজেডি : বিচার শুরু হয়নি, আসামীরা জামিনে

Spread the love

নাগরিক রিপোর্ট : পানি দিয়ে আগুন দমন করা হয়। ‘তাই আগুনের শত্রু পানি’- এমনটাই মনে করা হতো। তবে এই ধারনাকে পাল্টে দিয়েছে গতবছর এইদিন মধ্যরাতের একটি দূর্ঘটনা। ঝালকাঠী শহর সংলগ্ন সুগন্ধা নদীর মাঝে যাত্রীবাহি ‘অভিযান- ১০’

লঞ্চ টানা ৩ ঘন্টা আগুনে জ্বলেছে। যা ছিল দেশের ইতিহাসের একটি বিরল দূর্ঘটনা। প্রশাসনের হিসাবে দূর্ঘটনায় নিহত হন ৪১ জন যাত্রী। এখনও নিঁখোজ ১৬ জন। আগুনে পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়ায় অথবা আগুন থেকে বাঁচতে নদীতে ঝাপ দিয়ে ¯্রােতের টানে ভেসে গিয়ে তারা চিরতরে নিঁখোজ হয়েছেন- এমনটাই ধরে মনে করছেন তাদের স্বজনরা ও প্রশাসন।

সব দূর্ঘটনার পরই নিয়মমাফিক তদন্ত কমিটি ও মামলা হয়। দূর্ঘটনার কারন এবং ভবিষ্যতে যাতে এমন দূর্ঘটনা না ঘটে তার সুপারিশ উল্লেখ করে প্রতিবেদনও দেয় তদন্ত কমিটি। তবে সেইসব সুপারিশ কতখানী বাস্তবায়ন হয়- তা সাধারন মানুষের অজানা থেকে যায়।

অভিযান- ১০ লঞ্চের দূর্ঘটনার পর গঠিত তদন্ত কমিটির সুপারিশ কতখানী বাস্তবায়ন হয়েছে এবং মামলার বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, ব্যতিক্রম এই দূর্ঘটনার পর নৌপরিবহন অধিদপ্তর এবং বিআইডব্লিউটিএ’র কিছুটা টনক নড়েছে। অগ্নিদূর্ঘটনায় আগুন নেভানো এবং যাত্রীদের নিরপদে লঞ্চ থেকে নামানোর বাধ্যতামুলক প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে নৌযান শ্রমিকদের। তবে নৌপথের আগুন নেভানোর দায়িত্বরত নৌফায়ার সার্ভিসের দুরবস্থা আগের মতোই আছে।

নৌ আদালতের প্রসিকিউটিং অফিসার বেল্লাল হোসাইন বলেন, নৌদূর্ঘটনা সংক্রান্ত মামলাগুলোর মধ্যে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে দ্রততম বিচার কার্যক্রম চলছে অভিযান-১০ লঞ্চের মামলাটির। মামলাটি বর্তমানে আদালতে অভিযোগ গঠন পর্যায়ে রয়েছে। বিচারে অভিযোগ প্রমানিত হলে অভিযুক্তদের সর্বোচ্চ ৫ বছর কারাদন্ডসহ অর্থদন্ডে দন্ডিত করা হতে পারে।

দূর্ঘটনার পর নৌমন্ত্রাণালয় গঠিত ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন ফায়ার সার্ভিস সিভিল ডিফেন্সের তখনকার বরিশাল বিভাগীয় উপ পরিচালক (বর্তমানে কেন্দ্রীয় দপ্তরে) কামাল উদ্দিন ভূইয়া। তিনি বলেন, তারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন মন্ত্রাণালয়ে জমা দেন।

প্রতিবেদনে দূর্ঘটনার কারন লঞ্চের ইঞ্জিনের ত্রুটি চিহিৃত করা হয়। দুর্ঘটনার কয়েকদিন আগে লঞ্চটির সহনশীলতার চেয়ে উচ্চ ক্ষমতার একটি ইঞ্জিন স্থাপন করা হয়। এ কাজটি করার জন্য নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের অনুমতি নেয়নি মালিকপক্ষ। ওই ইঞ্জিন গরম হয়ে আগুনের সুত্রপাত হয়। লঞ্চটিতে অগ্নিনিবার্পক উপকরন যথেষ্ট ছিলনা। মাষ্টার-চালক ও শ্রমিকরা এ বিষয়ে ছিলেন অনিভজ্ঞ। কামাল উদ্দিন ভূইয়া বলেন, এ ধরনের দূর্ঘটনা এড়াতে ৭টি সুপারিশ উল্লেখ করেছেন তদন্ত প্রতিবেদনে।

ঢাকা-বরিশাল রুটের সুন্দরবন- ১০ লঞ্চের মাষ্টার মজিবর রহমান বলেন, অভিযান- ১০ লঞ্চ দূর্ঘটনার দুরপাল্লা রুটের সব লঞ্চেই অগ্নিনিবার্পক উপকরন থাকতো নামমাত্র। কোন কোন লঞ্চে কিছুই থাকতো না। নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা সরেজমিনে পরিদর্শন না করেই ম্যানেজ হয়ে লঞ্চ মালিকদের সনদ দিতেন। গত বছর অভিযান- ১০ ট্রাজেডির পর এসব নিয়ম বন্ধ হয়ে গেছে। নৌযানের মাষ্টার-চালকসহ শ্রমিকদের ৬দিনের বেসিক প্রশিক্ষন বাধ্যতামুলক করেছে বিআইডব্লিউটিএ। দূর্ঘটনা ঘটলে অগ্নিনির্বাপক উপকরন ব্যবহার এবং নিজেকে নিরাপদ রেখে যাত্রীদের লঞ্চ থেকে নামানোর প্রশিক্ষন দেয়া হয়। বেসিক প্রশিক্ষণ সনদ না থাকলে নৌযানে কাউকে চাকুরী দেয়া হয়না অথবা চাকুরীর পর প্রশিক্ষন নিতেই হবে।
একই কথা জানিয়ে পারবত- ৯ লঞ্চের সদ্য সাবেক মাষ্টার শামীম আহমেদ বলেন, প্রতিমাসে কমপক্ষে ১দিন নৌ পরিবহন অধিদপ্তর ও বিআইডব্লিউটিএ’র উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা লঞ্চে সরেজমিনে এসে সবকিছু যাচাই-বাছাই করেন।

অভিযান- ১০ লঞ্চটি গতবছর ২৩ সন্ধ্যায় ঢাকা থেকে রওনা হয়ে যাত্রী নিয়ে বরগুনায় যাচ্ছিল। যাত্রীদের দেয়া তথ্যমতে, বরিশাল নগরের দপদপিয়া সেতু অতিক্রম করার পর রাত সাড়ে ৩টার দিকে লঞ্চের নিচতলায় একটি বিস্ফোরনের শব্দ হয়েআগুন লাগে। এ অবস্থাতেই লঞ্চটি চলতে থাকে। প্রায় আধাঘণ্টা পর ঝালকাঠী শহরের বিপরীত দিকে পোনাবালিয়ার দিয়াকুল গ্রামে লঞ্চ তীরে ভিড়িয়ে লঞ্চ কর্মচারীরা পালিয়ে যান। লঞ্চটি ¯্রােতের টানে আবার মাঝ নদীতে চলে যায়। মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ নামক এক যাত্রী দূর্ঘটনার দিন সমকালকে বলেছিলেন মধ্যরাতে ২/৩ টা শব্দ শুনতে পান। এরপর নীচে সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে দেখেন আগুন, আবার উপরে গিয়ে সেখানেও আগুন দেখতে পান। লঞ্চে আগুন নিচে পানি। দিশেহারা হয়ে তিনি নদীতে লাফ দেন।

মামলার খবর : অভিযান- ১০ লঞ্চের দূর্ঘটনার ঘটনার পরদিন ঝালকাঠী সদর উপজেলার পোনাবালিয়া ইউনিয়নের গ্রাম পুলিশ জাহাঙ্গীর হোসেন বাদী হয়ে স্থানীয় একটি অপমৃত্যু মামলা দায়ের করেছিলেন। এ মামলায় লঞ্চ কর্মচারীদের অজ্ঞাতনামা হিসাবে উল্লেখ করা হয়। এছাড়া নৌ আদালতে পৃথক আরেকটি মামলা করেন নৌ অধিদপ্তরের মুখ্য পরিদর্শক মো. শফিকুর রহমান। এই মামলায় লঞ্চের ৪জন ও ৪জন মাষ্টার-চালকের নাম উল্লেখ করা হয়। মালিকদের বিরুদ্ধে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে, তারা নৌ অধিদপ্তরের অনুমতি ছাড়া দূর্ঘটনার কয়েকদিন আগে লঞ্চে শক্তিশালী ইঞ্জিন স্থাপন করেছেন। ইঞ্জিনটি লঞ্চের সঙ্গে সহনশীল না হওয়ায় দ্রুত গরম হয়ে অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটে। অপরদিকে মাষ্টার-চালকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ- আগুন লাগার পর নোঙ্গর করে যাত্রীদের লঞ্চ থেকে নামার ব্যবস্থা না করে তারা লঞ্চ থেকে নেমে পালিয়ে যান।

প্রসিকিউটিং অফিসার জানান, নৌযান দূর্ঘটনা সংশ্লিষ্ট মামলাগুলোর বিচার হয় নৌ আদালতে। যেহেতু একই ঘটনা নিয়ে দুটি আলাদা মামলা হয়েছে। তাই ঝালকাঠীর মামলা বদলী করে নৌ আদালতে এনে দুটি মামলা একটি মামলায় পরিনত করা হয়েছে।

আদালত সুত্রে জানা গেছে, দূর্ঘটনার পর ২৭ ডিসেম্বর লঞ্চটির মালিক মো. হামজালাল শেখকে র‌্যাব এবং পরবর্তীতে অপর দুইমালিক শামীম আহমেদ ও রাসেল আহমেদ, লঞ্চের মাষ্টার রিয়াজ আহমেদ ও খলিলুর রহমান, চালক মাসুম বিল্লাহ ও আবুল কালামকে বিভিন্ন সময়ে গোয়েন্দা পুলিশ গ্রেপ্তার করে। তারা প্রত্যেকেই ৪ মাসের অধিক কারাভোগ করে বর্তমানে জামিনে মুক্ত রয়েছেন। পৈত্রিক সুত্রে মালিক ফেরদৌস হাসান নাবালক হওয়ায় তিনি গ্রেপ্তারের আগেই উচ্চাদালত থেকে জামিন পান।

লঞ্চ-মালিক-শ্রমিক কোথায় : দূর্ঘটনার দুইদিন পর অভিযান-১০ লঞ্চ ঝালকাঠী ডিসিপার্ক সংলগ্ন সুগন্ধা নদীতে প্রশাসনের হেফাজতে রাখা হয়েছিল। আদালতের নির্দেশে গত ২৬ জুলাই মালিক হেফাজতে দেয়া হয়। মালিক হামজালাল শেখ সমকালকে বলেন, ধলেশ্বর নদীর ধর্মগঞ্জ এলাকায় একটি ডর্কইয়াডে রেখে লঞ্চটি সংস্কার করা হচ্ছে। তিনি মাষ্টার-চালকদের বক্তব্যের বরাত দিয়ে বলেন, ৩-৪ সেকেন্ডের মধ্যে আগুন নিচতলা থেকে তিনতলায় পৌছে যায়। নাশকতা ছাড়া এভাবে আগুন ছড়ানো সম্ভব নয়। নৌ অধিদপ্তরের অনুমতি ছাড়া শক্তিশালী ইঞ্জিন স্থাপনের কথা স্বীকার করে বলেন, ব্যস্ততার কারনে অনুমতি নেয়া হয়নি। তবে এটা দূর্ঘটনার কোন কারন নয় বলে দাবী তার।

লঞ্চ লেবার এসোশিয়েসনের সহ প্রচার সম্পাদক আব্দুল কুদ্দুস বলেন, দূর্ঘটনার পর চারজন মাষ্টার-চালকের সনদ বিআইডব্লিউটিএ স্থগিত করেছিলো। পরে তাদের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করা হয়। চালক মাসুম ঢাকা-চরমোন্তাজ রুটে আসা-যাওয়া-২ লঞ্চে কর্মরত আছেন। মাষ্টার রিয়াজ ও চালক খলিলও অন্য জাহাজে চাকুরী পেয়েছেন। শুধুমাত্র মাষ্টার খলিলুর রহমান বেকার।

অগ্নিঘাতক আগের মতোই : নদীতে অগ্নিদুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে নৌ ফায়ার স্টেশনের সবচেয়ে শক্তিশালী জাহাজের নাম ‘অগ্নিঘাতক’। বরিশাল নৌ ফায়ার স্টেশনের আওতাধীন এ জাহাজটির স্থায়ী ঠিকানা নগরীর পরিত্যক্ত মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র সংলগ্ন কীর্তনখোলা নদীতীরে। সেখান থেকে ১৭ কিলোমিটার দূরে ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে গতবছর ২৩ ডিসেম্বর দিবাগত মধ্যরাতে ঢাকা থেকে বরগুনাগামী অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটে। খবর পেয়ে ‘অগ্নিঘাতক’ রাত ৩টা ২০ মিনিটে রওনা হয়ে পরদিন বিকেল ৩টার দিকে ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। অর্থাৎ ১৭ কিলোমিটার দূরের ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে অগ্নিঘাতকের সময় লেগেছে ১২ ঘণ্টা। রাতের কুয়াশা ভেদ করে নৌযানটির চলার সক্ষমতা না থাকায় এ অবস্থা হয়েছিল বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, অগ্নিঘাতক ১৯৯৩ সালে নির্মিত হয়। সেটির গতি কমে গেছে। কুয়াশা ভেদ করে চলার শক্তিশালী রাডার নেই।

নদীমাতৃক দক্ষিণাঞ্চলের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বরিশাল নৌ ফায়ার স্টেশন। বরিশাল বিভাগের ছয় জেলা এবং ঢাকা বিভাগের ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও রাজবাড়ী জেলা এই ষ্টেশনটির অন্তর্ভৃক্ত। আগুন নিয়ন্ত্রনে তাদের শক্তিশালী জলযান সম্বল অগ্নিঘাতকের গতি নেই। দুর্ঘটনাকবলিত ব্যক্তিকে দ্রুত হাসপাতালে পাঠাতে নেই একটি রিভার অ্যাম্বুলেন্স। ঢাল-তলোয়ারহীন একটি প্রতিষ্ঠানের নাম বরিশাল নৌ ফায়ার স্টেশন।

ষ্টেশন কর্মকর্তা রেজাউল করীম বলেন, অগ্নিঘাতক আগের মতোই আছে। খুলনা শিপইয়র্ডের প্রকৌশলী টিম কিছুদিন আগে পরিদর্শন করে গেছেন। তাদের প্রতিবেদনের পর সংস্কারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ।##

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *