ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত বাংলাদেশি তানিয়া জয়া। ছিলেন জঙ্গি সংগঠন আইএসের সদস্য। নিজের ভুল বুঝে সেই পথ থেকে ফিরে এসে বর্তমানে কাজ করছেন শান্তি ও উগ্রবাদবিরোধী ক্যাম্পেইনার হিসেবে।

Spread the love

নাগরিক ডেস্ক ।। বছর ছয়েক আগের কথা। ব্রিটিশ মুসলিম তানিয়া জয়া তার স্বামীর সঙ্গে সিরিয়ায় বসবাস করত। তার স্বামী ছিল আমেরিকান, যে কি-না পরে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল এবং ইসলামিক স্টেটের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি হয়ে উঠেছিল। তানিয়ার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, তার সাবেক স্বামী জন জর্জলাস অনেক বছর ধরে আল বাহরুমী নামে সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেটের সঙ্গে সক্রিয়। যেখানে সে জিহাদি গ্রুপের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে ইংরেজি ভাষা প্রচার ও প্রসারের কাজে নিয়োজিত। তানিয়া ছিল স্বীকৃতিপ্রাপ্ত একজন কট্টর ইসলামী উগ্রপন্থির কর্তব্যপরায়ণ স্ত্রী। তাই অনেকের মনে সন্দেহ ছিল, এ রকম একটা অবস্থান থেকে নিজেকে সরিয়ে আনা বা ফিরে আসা আদৌ সম্ভম কি-না!

গত বছর এক ব্রিটিশ টেলিভিশন চ্যানেল তানিয়ার কাছে জানতে চেয়েছিল, সে এখনও তার স্বামীকে ভালোবাসে কি-না? প্রত্যুত্তরে তানিয়া বলে, প্রত্যেকটি মানুষের ভালো ও মন্দ দুটি দিক থাকে। আমি তার প্রেমে পড়েছিলাম এবং ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম। মানুষ হিসেবে তাকে আমি ভালোবাসি। সে আমার চার সন্তানের বাবা। তবে যদি সে ধরা পড়ে তাহলে তার কৃতকর্মের জন্য অবশ্যই তাকে শাস্তি পেতে হবে।

তানিয়ার জন্ম বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এক সল্ফ্ভ্রান্ত পরিবারে। মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও ধর্মীয় গোঁড়ামি সেখানে ছিল না। ২০০৩ সালে মুসলিম বিয়ে সম্পর্কিত একটি ওয়েবসাইটে তার সঙ্গে জন জর্জলাস/আল বাহরুমীর পরিচয় হয়। সে তখন দামেস্কে আরবি ভাষা নিয়ে পড়ালেখা করছিল। ৯/১১-এর অল্প কিছু সময় পরে সে মুসলিম হিসেবে ধর্মান্তরিত হয়। তারপর থেকে তার মধ্যে ধর্মীয় উগ্রবাদের বিভিন্ন বিষয় বাসা বাঁধতে থাকে। আল বাহরুমী প্রথমে ই-মেইলে তানিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং পরে তার সঙ্গে দেখা করতে ইংল্যান্ড আসে। তার পরনে ছিল একটি রোমশ বিবর্ণ জামা আর গালে ছিল আংশিক দাড়ি। আকর্ষণ করার মতো তেমন কিছু তার মধ্যে ছিল না, তবুও অদৃশ্য কোনো এক আকর্ষণে তাকে আমি ভালোবাসতে শুরু করলাম। সুদূর সিরিয়া থেকে সে আমার জন্য এতদূর এসেছে, এই বোধটাই হয়তো তখন আমার মধ্যে কাজ করছিল। সে মধ্যপ্রাচ্যে থাকার কথা বলত। ধীরে ধীরে তার মধ্যে জিহাদের ধারণা জন্ম নিতে লাগল। তার মতে এটাই হলো মুক্তির একমাত্র পথ। আমার বাবা-মা আমেরিকান ছেলের ধর্মীয় এমন আচরণে মুগ্ধ হন এবং তাকে মেয়ের বর হিসেবে গ্রহণে সম্মতি দেন। খুব অল্প সময়ের মধ্যে তারা বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হয়। জয়া বলে, আমার বয়স তখন ১৯ আর ওর ১৮। মাস দুয়েক পর আনুষ্ঠানিকতা শেষে তারা একত্রে সংসারজীবন শুরু করে। বিয়ের অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ইসলামী পোশাক ও হিজাব জয়ার সাধারণ পোশাকে পরিণত হয়। তারপর তারা টেক্সাস চলে যায় ও পরে লন্ডন, সিরিয়া, ডালাস, ক্যালিফোর্নিয়াসহ বিভিন্ন স্থানে বসবাস করে। সেখান থেকে তার স্বামী জিহাদি প্রচারণার জন্য টেক সাপোর্ট দিত। সে তখন রেকস্পেস নামে প্রথম সারির একটি কম্পিউটার সার্ভার ফার্মে কর্মরত। ২০০৬ সালে ইসরায়েলের অওচঅঈ পাসওয়ার্ড পাচার ও ওয়েবসাইট হ্যাকের দরুন তাকে গ্রেফতার করে তিন বছরের কারাদণ্ড প্রদান করে। জেলে থাকাকালে উভয়ের মধ্যে একটি দূরত্বের সৃষ্টি হয়। জেল থেকে ফেরার পর সে আরও বেশি উন্মত্ত হয়ে ওঠে। মুক্ত হওয়ার পর আল বাহরুমীর পরবর্তী গন্তব্য হয় মিসর। ঠিক যেন আরব বসন্তের মতো হয়ে উঠছিল তার দিন এবং শিগগিরই সে ওঝওঝ এর একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে। ইউরোপ থেকে নিয়োগপ্রাপ্তদের অনলাইনে আরবি ও ইংরেজিতে সেমিনার দেওয়ার কাজে নিয়োজিত থাকে। তারপর ২০১৩ সালে সে জয়া ও তার তিন সন্তানকে সিরিয়ায় নিয়ে যায়। সে সময় সে ছিল খুব কঠোর। দীর্ঘদিন দূরত্বের কারণে অনেকটা বিপথগামীও হয়ে গিয়েছিল। তার হাতে ছিল অনেক ক্ষমতা আর সে কারণে বেশি অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছিল। আমার কখনও ইচ্ছা ছিল না ছোট ছোট ৮, ৫ ও ২ বছরের তিনটা বাচ্চা নিয়ে সিরিয়ায় যাওয়ার। সে জোর করে আমাদের একটা বাসে ওঠাল। আজাজে তিন সপ্তাহ কাটানোর পর জানাল, সে আর ফিরবে না। আমি অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলাম কিন্তু সে কিছুই শুনতে চাইল না। এক সকালে সে আমাদের সীমান্তের কাছাকাছি এনে রাখে। সেখানে বেড়ার নিচে লুক্কায়িত একটি গর্ত দিয়ে আমি সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে পালিয়ে আসি।

তারপর অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে তানিয়া এখন টেক্সাসে। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাহরুমীর সঙ্গে তার ডিভোর্স হয় এবং ২০১৮ সালের জুন মাসে ক্রেইগ বার্মার সঙ্গে তানিয়ার দ্বিতীয় বিয়ে হয়। ওঝওঝ এর ফার্স্ট লেডি হিসেবে পরিচিত কলঙ্কিত একটি অধ্যায় থেকে নিজেকে মুক্ত করার মতো দুঃসাহসী কাজ করে তানিয়া এখন নির্মল, সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন জীবনের স্বপ্ন নিয়ে পথ হাঁটছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *