কুয়াকাটায় দখল : মাহবুবের বদলে এবার মহিব এমপি

Spread the love

এমপি বদল হলেও বন্ধ হয়নি জমি দখল। এর আগে টানা তিনবারের এমপি ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী মাহবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে জমি দখলের অভিযোগ উঠেছিল। একাদশ সংসদ নির্বাচনে তাই নাকি তার ভাগ্যে জোটেনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন। তার বদলে প্রথমবারের মতো মনোনয়ন পেয়ে এমপি হন তারই ফুফাতো ভাই মহিববুর রহমান। কিন্তু তার বিরুদ্ধেও উঠছে একই অভিযোগ।

সর্বশেষ সংসদ নির্বাচনের এক সপ্তাহ পার না হতেই নতুন এমপি দখল করে নেন কুয়াকাটার পাউবোর রেস্টহাউস-সংলগ্ন জমি। এর আগেও তিনি কয়েক দফা চেষ্টা করেছিলেন জমিটি দখল করার। যদিও সফল হননি। কিন্তু এমপি হওয়ার পরে আর অপেক্ষা করেননি। নির্বাচনের কয়েক মাস আগেও তার বাহিনী ১০-১২টি দোকান ভাংচুর ও লুটপাট করে এবং বেশ কয়েকজনকে জমি থেকে উচ্ছেদ করে। এর মধ্যে কুয়াকাটা পৌরসভা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অনন্ত মুখার্জি ২০১৭ সালে একটি ফৌজদারি মামলা করেন। এতে মহিববুরসহ ৩০ জনকে আসামি করা হয়। ওই ঘটনায় স্থানীয় পুলিশের এক তদন্ত প্রতিবেদনে এই গ্রুপকে ‘সন্ত্রাসী মহিব বাহিনী’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এমপি হওয়ার পর তিনি এই মামলা থেকে পুলিশি তদন্তে বাদ পড়েন। মামলাটি সম্পর্কে নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হলফনামায় মহিববুর রহমান বলেছেন, ‘পুলিশি তদন্তে মামলা থেকে অব্যাহতি প্রদান। বাদীর আপত্তিতে অধিকতর তদন্তাধীন।’

স্থানীয়রা বলছেন, ‘যায় দিন ভালো, আসে দিন খারাপ’- প্রবাদবাক্যের মতোই তাদের ওপর যন্ত্রণা অনেক ক্ষেত্রে আগের তুলনায় বেড়েছে। আগের এমপি মাহবুবুর রহমান এখন আর এলাকাবাসী বা দলীয় নেতাকর্মীর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেন না। তখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জমি দখলের অভিযোগ ছিল এমপির আত্মীয়-স্বজনের বিরুদ্ধে। এবার এমপি নিজেই দখলে নেমেছেন। জাল দলিল দিয়ে একের পর এক জমি দখল করছেন। তার এই দখলে সরকারি সংস্থা পানি উন্নয়ন বোর্ডের জমিও রয়েছে। স্থানীয়দের সম্পত্তিও রয়েছে। বাদ যায়নি দলীয় লোকজনের জমিও।

এমপি মহিববুর রহমান মনে করেন, আগের এমপি মাহবুবুর রহমান তার ভাই হলেও রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে তার বিরুদ্ধে কিছু মানুষকে ইন্ধন জোগাচ্ছেন। এলাকায় তার স্বচ্ছ ভাবমূর্তি রয়েছে। এমপি হওয়ার পরের সপ্তাহেই জমি দখলে নেওয়ার যৌক্তিকতা সম্পর্কে মহিববুর বলেন, আগে থেকেই তিনি চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু আগের এমপি পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মাহবুবুর রহমানের কারণে তিনি জমির দখলে যেতে পারেননি। নির্বাচিত হওয়ার পর ওই জমিতে যেসব দোকানপাট ছিল তারা নিজেরাই জমি ছেড়ে চলে গেছেন।

আদালতের স্থগিতাদেশও মানছেন না এমপি : পাউবোর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এমপি মহিববুরের দখল করা দুই একর জমির মধ্যে পাউবোর জমি আট শতাংশ। এই আট শতাংশ উদ্ধার ছাড়াও আরও কয়েকজন দখলদারকে বিবাদী করে তারা আদালতে মামলা করেছেন। বিরোধীয় সম্পত্তিতে কোনো ধরনের স্থাপনা নির্মাণের বিষয়ে আদালতের স্থগিতাদেশ রয়েছে। কিন্তু ৯ সেপ্টেম্বর জেলা প্রশাসকের নির্দেশে স্থানীয় প্রশাসন ওই জমি মাপজোখ করেন। এরপর কাউকে কিছু না জানিয়ে এমপির লোকজন সেখানে ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করেন। পাউবোর পক্ষ থেকে ১৪ সেপ্টেম্বর স্থানীয় মহিপুর থানার ওসিকে চিঠি দিয়ে নির্মাণকাজ বন্ধ করার অনুরোধ জানানো হয়। থানার পক্ষ থেকে কোনো ধরনের সাড়া না পেয়ে তারা স্থানীয় প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেন। তাতেও কোনো সাড়া না পাওয়ায় বিষয়টি পানিসম্পদ সচিবকে জানানো হয়। এরপর পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে এমপির নির্মাণকাজ বন্ধ করতে জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দিলে কলাপাড়ার সহকারী কমিশনার (ভূমি) ঘটনাস্থলে গিয়ে নির্মাণকাজ বন্ধ করে দেন। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় একাধিক সূত্র জানিয়েছে, এমপির লোকজন রাতের আঁধারে নির্মাণকাজ অব্যাহত রেখেছিলেন।

এমপি মহিববুর রহমান অবশ্য দাবি করেছেন, সেখানে কোনো নির্মাণকাজ হয়নি। জেলা প্রশাসকের কাছে তিনি এক আবেদনে তার জমি বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য বলেছিলেন। ওই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে স্থানীয় প্রশাসন তার জমি মাপজোখ করে বুঝিয়ে দিয়েছেন এবং লাল পতাকা দিয়ে সীমানা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। আদালতের স্থগিতাদেশের মধ্যে এই মাপজোখ কতটা যৌক্তিক- এমন প্রশ্নের জবাবে মহিববুর রহমান বলেন, আদালত অবমাননা বা বেআইনি কিছু হলে জেলা প্রশাসক এই কাজ করলেন কেন? এই মাপজোখের সময় পাউবোর প্রতিনিধিও উপস্থিত ছিলেন বলে দাবি করেন এমপি মহিববুর।

কলাপাড়ার সহকারী কমিশনার (ভূমি) অনুপ দাশ জানান, জেলা প্রশাসকের নির্দেশে তিনি ৯ সেপ্টেম্বর জমির মাপজোখ করতে সেখানে গিয়েছিলেন। কিন্তু কোনো সীমানা নির্ধারণ করে দেননি। তিনি জানান, মাপজোখ করতে যাওয়ার তিন দিন পর আদালতের আদেশ সম্পর্কে তিনি জানতে পেরেছেন। আগে বিষয়টি জানা থাকলে তিনি ওখানে যেতেন না।

তিনি আরও বলেন, মাপজোখের পরে সেখানে এমপির পক্ষ থেকে নির্মাণকাজ শুরুর কোনো সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়নি। নির্মাণকাজ শুরুর খবর শুনে কলাপাড়া পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী খান মোহাম্মদ ওয়ালিউজ্জামানকে সঙ্গে নিয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে তিনি দেখতে পেয়েছেন ৫টির মতো পিলার স্থাপনের জন্য মাটি খোঁড়া হয়েছে। নির্মাণসামগ্রী জড়ো করা হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে সেখানে কর্মরত শ্রমিকদের কাজ বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

পাউবোর কলাপাড়া কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী খান মোহাম্মদ ওয়ালিউজ্জামান বলেন, পাউবো রেকর্ড সংশোধনীর জন্য মামলা করেছে, যেটা এখনও চলমান। পাউবোর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত স্থিতাবস্থা বজায় রাখার নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি জানান, জজকোর্টের স্থিতাবস্থা ভ্যাকেট (স্থগিতাদেশ চেয়ে) করতে এমপি উচ্চ আদালতে গিয়েছিলেন। উচ্চ আদালত তার আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে তিনি সেখানে স্থাপনা নির্মাণ করতে পারেন না। এটা আদালত অবমাননার শামিল।

এমপির কারণে আরও যারা বাড়িঘর ছাড়া :স্থানীয়দের অভিযোগ, এমপি মহিববুর রহমান ‘জাল দলিলের’ ভিত্তিতে এই জমি দখলে নিয়েছেন। এমপির দাবি, ১৯৯৭ সালে তিনি সেফরি মগের কন্যা প্লেচিং মগনির (উপজাতি) কাছ থেকে ২ একর জমি কিনেছেন। কিন্তু গত বছরের মে মাসে পুলিশের এক তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৮০ সালে সেফরি মগ তার পুরো জমি ১০ দশমিক ০৮ একরের মধ্যে মাওলানা শাহ মো. সিদ্দিকের (ছারছীনার হুজুর) কাছে ৬ দশমিক ০৮ একর এবং বাকি ৪ একর জমি ক্রঞ্জয় মাতবরের কাছে বিক্রি করেন। এই জমিতে যাদের বাড়িঘর ছিল তাদের সবাইকেই উচ্ছেদ করা হয়েছে।

এমপি মহিববুরের দাবি, জমি ক্রয়ের পরে তিনি নামজারি করিয়েছেন। বিএস জরিপে এই জমি তার নামে রেকর্ডও হয়েছে। তাকে বিবাদী করে আদালতে পাউবো মামলা করেছে, কিন্তু রেকর্ড এখনও সংশোধন হয়নি। মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত এই জমি তার। তিনি বলেন, সম্প্রতি পাউবোর পরিচালক (ভূমি) রেজাউল করিম মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে বিরোধী এলাকা তদন্ত করেছেন। সেখানে তিনি অনেক লোকজনের সামনে প্রকাশ্যে বলেছেন, এখানে পাউবোর জমি নেই। আদালতে তার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহারের জন্যও স্থানীয় পাউবোর কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন। রেজাউল করিমের ওই রেকর্ড করা বক্তব্য তার কাছে রয়েছে বলে তিনি দাবি করেন। মহিববুর রহমান আরও জানান, পাউবো জমি অধিগ্রহণ করেছে শূন্য দশমিক ৩৮ শতাংশ। কিন্তু তাদের দখলে রয়েছে শূন্য দশমিক ৭০ শতাংশ। তবে তিনি বলেন, পাউবোর অনেক জমি অবৈধ দখলদারের কবলে রয়েছে।

তবে পাউবোর পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব, ভূমি ও রাজস্ব) রেজাউল করিম জানিয়েছেন, তিনি কুয়াকাটা গিয়েছিলেন ঠিকই। কিন্তু সংশ্নিষ্ট জমির বিরোধ তার তদন্তের বিষয় ছিল না। প্রতিমন্ত্রীর দপ্তরে একটি বেনামি আবেদনের বিষয়ে তিনি সত্যতা যাচাই করতে সেখানে গিয়েছিলেন। বেড়িবাঁধের কাছে পাউবোর জমি দখল করে সমিতির অফিস বানানো হয়েছে। এ সময় তিনি পানি উন্নয়ন বোর্ডের কুয়াকাটা রেস্টহাউস-সংলগ্ন জমি নিয়ে স্থানীয় এমপির সঙ্গে বিরোধের বিষয়টি শুনেছেন। তিনি বলেন, পটুয়াখালী জেলা প্রশাসক এ ব্যাপারে একটি কমিটি করে দিয়েছেন বলে তিনি শুনেছেন। এখানেও একটু সমস্যা রয়েছে। কিন্তু সেটা তার তদন্তের বিষয় ছিল না।

এদিকে এমপির দাবি ‘ভিত্তিহীন’ দাবি করে পৌর আওয়ামী লীগ নেতা অনন্ত মুখার্জি বলেছেন, ৪০ বছর আগে তিনি এই জমি কিনছেন। সেখান থেকে তাকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। তার দখলে থাকা (বিএস দাগ নং ৩২৪৮) জমি এমপির দলিলেই নেই। তারপরও তাকেসহ অন্যদের ওপর সশস্ত্র হামলা চালিয়ে মহিববুর রহমান উচ্ছেদ করে দিয়েছেন এমপি হওয়ার আগেই। তিনি এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, দলীয় সাধারণ সম্পাদক, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইজিপিসহ দল ও প্রশাসনের সর্বস্তরে জানিয়েছেন।

অনন্ত মুখার্জির এই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (পটুয়াখালী) মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান ২০১৮ সালের মে মাসের শুরুতে এক তদন্ত প্রতিবেদন জেলা পুলিশ সুপারের কাছে দাখিল করেন। প্রতিবেদনে বলা হয়, “২০১৭ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা ৭টার দিকে ‘সন্ত্রাসী’ মহিববুর রহমান মহিব বাহিনী প্রায় ৩০-৩৫টি মোটরসাইকেলে শতাধিক সন্ত্রাসী ও ভূমি দখলবাজদের নিয়ে কুয়াকাটা বাজারের একাংশ দখল করতে এসে অনন্ত মুখার্জি ও যুবলীগ সভাপতিসহ বেশ কয়েকজনকে অতর্কিত মারধর, ভাংচুর ও লুটপাট করে ২০ লক্ষাধিক টাকার সম্পদ নষ্ট করে। এ সময় স্থানীয় জনতা মহিব বাহিনীকে কুয়াকাটা পর্যটন হোটেলে রাতভর অবরুদ্ধ করে রাখে। ভোররাতে পুলিশভ্যানে পুলিশের পোশাক পরিয়ে তাদের নিয়ে যাওয়া হয়।” এই প্রতিবেদন জমা দেওয়ার ৭ মাসের মাথায় এমপি নির্বাচিত হন মহিববুর রহমান।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, মহিব বাহিনীর ওই হামলায় স্থানীয় দোকানদার শাহ মো. ওয়ালিউল্লাহ হানিফ, ছগির ফরাজী, অনন্ত কুমার মুখার্জি, নাসির উদ্দিন, আশ্রাফ আলী সিকদার, দুলাল আকন, হাজি চাঁন মিয়া, ফজলুল হক খাঁ ও আব্দুল মান্নান হাওলাদারের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান লুট হয় এবং তাদের জমি থেকে উচ্ছেদ করে দেওয়া হয়।

ছারছীনা হুজুরের কাছ থেকে জমি কিনেছিলেন কারি খালেক। তার মেয়ে সুরভী আক্তার দাবি করেন, এসব দোকানদার তাদের কাছ থেকে জমি কিনে ভোগদখলে ছিলেন। এসবের পাশাপাশি তাদের কৃষিজমিও এমপির লোকজন দখল করে নিয়েছেন। এসব জমি তারা বর্গাচাষিদের দিয়ে চাষ করিয়েছেন, এমন রেকর্ড তাদের কাছে রয়েছে। কিন্তু মহিববুর রহমান এর আগে যখন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন, তখন থেকেই তাদের কাছ থেকে ধীরে ধীরে জমি দখল শুরু করেন। এখন এমপি নির্বাচিত হওয়ার পরে তার অপতৎপরতা আরও বেড়েছে।

ক্রঞ্জয় মাতবরের কাছ থেকে জমি কিনে ভোগদখল করছেন এমন একজন সিদ্দিকুর রহমান বাবু। তিনি জানান, এমপি মহিববুর রহমানের সঙ্গে যোগসাজশে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আজিজ মুসল্লি ভুয়া ওয়ারিশ সার্টিফিকেট দিয়ে মগদের ওয়ারিশের কাছ থেকে দলিল করেছেন। ১৯৮৯ সাল থেকে তিনি এই জমিতে বাড়ি ঘর তুলে ভোগদখলে ছিলেন। একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর চলতি বছরের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে তার বাড়িঘর থেকে তাকে উচ্ছেদ করে দিয়েছেন এমপি মহিব।

সুত্- দৈনিক সমকাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *