আই.এস প্রধান বাগদাদি বৃত্তান্ত

Spread the love

অবশেষে নিহত হলেন আবু বকর আল-বাগদাদি। তারই প্রতিষ্ঠিত ইসলামিক স্টেট বিশ্বের শতাধিক দেশ থেকে সদস্য সংগ্রহ করে হয়ে উঠেছে বৈশ্বিক এক সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক। পাগড়ি পরিহিত এই জঙ্গি নেতার বয়স হয়েছিল ৪৮ বছর। এর আগে অনেকবারই তার মৃত্যুর খবর সংবাদ মাধ্যমে এলেও, সেই সংবাদ পরে ভুল প্রমাণিত হয়েছিল। তবে কোনোবারই কোনো দেশের সরকার থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে তার নিহত হওয়ার ঘোষণা দেয়া হয়নি। এবার খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা দিলেন উত্তর-পূর্ব সিরিয়ায় মার্কিন বিশেষ বাহিনীর অভিযান চলাকালে আত্মঘাতি বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নিহত হন তিনি। অবশ্য এখন অবদি ইসলামিক স্টেটের সংবাদ মাধ্যম শাখা এ সংবাদের সত্যতা নিশ্চিত করেনি। তবে এ-ও সত্য, বিভিন্ন হামলার দায় খুব দ্রুতই স্বীকার করলেও, নিজেদের নেতাদের মৃত্যুর সংবাদ নিশ্চিত করতে বা অস্বীকার করতে সময় নেয় সংগঠনটি।

ইরাকের সামারা শহরের ধর্মপ্রাণ সুন্নি পরিবারে জন্ম বাগদাদির। তার মধ্যে ধর্মীয় আবেগ যেমন ছিল, তেমনি ছিল অন্য ধর্মাবলম্বীদের জন্য বিদ্বেষ। তিনি ইন্টারনেটকে কাজে লাগিয়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন বিশ্বমঞ্চে। তার নেতৃত্বে ছিল এমন এক সংগঠন, যেটি নিজেদের সবচেয়ে সাফল্যময় সময়ে বৃটেনের সমান ভূখণ্ডনিয়ন্ত্রণ করেছে। এই সংগঠন থেকে অনুপ্রাণিত বা নির্দেশিত হয়ে প্রায় ৩ ডজন দেশে হামলা চালিয়েছে তার অনুসারীরা।

বিশ্বের মোস্ট ওয়ান্টেড সন্ত্রাসী প্রধান ছিলেন তিনি। আমেরিকার সরকার তার সম্পর্কে তথ্যের জন্য ২৫ মিলিয়ন ডলার পুরষ্কার ঘোষণা করেছিল। কয়েক বছর ধরে তাকে ধরার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল বেশ কয়েকটি দেশ। বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দা সংস্থা তার সন্ধানে লেগে ছিল। প্রায় ১ দশক ধরে লুকিয়ে থাকতে সক্ষম হন আল-বাগদাদি। তার নিরাপত্তার জন্য নানা স্তরের কঠোর ব্যবস্থা কার্যকর করা ছিল। নিজের সবচেয়ে আস্থাভাজন সহযোগীর সঙ্গে সাক্ষাতের ক্ষেত্রেও এই নিয়মের ব্যত্যয় হয়নি। গত বছর গ্রেপ্তার হওয়া বাগদাদির অন্যতম সহযোগী ইসমাইল আল-ইথাওয়ি বলেন, ‘আমার হাতের ঘড়ি পর্যন্ত খুলে রাখতে হয়েছিল।’ সকল ধরণের ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস সরিয়ে রাখার পরও সাক্ষাতপ্রার্থীদের চোখ বেঁধে ফেলা হতো। এরপর বাসে ঢুকিয়ে কয়েক ঘন্টা গাড়ি চালিয়ে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হতো। যখন তাদের চোখের বাঁধন খুলে ফেলা হতো, তখন তারা দেখতে পেতেন আল-বাগদাদি তাদের সামনে বসে আছেন। বৈঠক সাধারণত ১৫-৩০ মিনিটের মধ্যে শেষ হতো। বৈঠক শেষে আল-বাগদাদিই আগে বের হতেন ভবন থেকে। তিনি চলে যাওয়ার পরও অতিথিরা সশস্ত্র পাহারায় থাকতেন কয়েক ঘণ্টা। এরপরই আবারও তাদের চোখ বেঁধে ফেলা হতো। এবং গাড়িতে করে আগের স্থানে রেখে আসা হতো। ইরাকি জয়েন্ট অপারেশন কমান্ডের মুখপাত্র জেনারেল ইয়াহিয়া রাসুল বলেন, ‘বাগদাদির মাথায় সবসময় একটা চিন্তাই ঘুরতো: আমার সঙ্গে কে বিশ্বাসঘাতকতা করবে? তিনি আসলে কাউকেই বিশ্বাস করতেন না।’

দুনিয়ার বেশিরভাগ মানুষ আল-বাগদাদির নাম প্রথম শোনেন ২০১৪ সালে। ওই সময় তার অনুসারীরা ইরাকের এক-তৃতীয়াংশ ও প্রতিবেশী সিরিয়ার অর্ধেক নিয়ন্ত্রণ করতো। তখনই নিজেদের নিয়ন্ত্রণাধীন অঞ্চলকে খিলাফত ঘোষণা করেন তিনি। এর মাধ্যমেই আরেক বৃহৎ ও পুরোনো জঙ্গি সংগঠন আল কায়েদার সঙ্গে নিজেদের স্বাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে আইএস। আল বাগদাদির অনুসারীরা একসময় আল কায়দার পৃষ্ঠপোষকতায় চলেছেন প্রায় এক দশক। পরে বেশ সহিংসভাবেই সেখান থেকে বের হয়ে আসেন তিনি।

আল কায়েদার নেতা ওসামা বিন লাদেনও খিলাফত পুনঃপ্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন। কিন্তু তিনি এ নিয়ে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিতে দ্বিধান্বিত ছিলেন। তার আশঙ্কা ছিল এমনটা করলে তার জবাবে ব্যাপক সামরিক প্রতিক্রিয়া আসবে। তার সেই আশঙ্কা সত্যি ছিল। বাগদাদির ক্ষেত্রে ঠিক তা-ই হয়েছিল। এবং শেষ অবদি নিয়ন্ত্রিত এলাকা তাকে ছাড়তে হয়।
কিন্তু বাগদাদির শাসনাধীন অঞ্চলের শেষ অংশটুকু নিজেদের দখলে নিতে বিভিন্ন দেশের সেনাবাহিনীর ৫ বছর লেগে যায়। নিজেদের সবচেয়ে শক্তিশালী মুহূর্তে আইএস-এর কালো পতাকা উড়েছে সবচেয়ে জনবহুল কিছু এলাকায়। পূর্বে প্রাচীন নিনেভেহ শহর থেকে উত্তরে সিনজার পর্বতমালা। পালমিরা থেকে সিরিয়ার তেলক্ষেত্র দেইর আজোর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল আইএস’র রাজত্ব। বাইবেলে উল্লেখিত শহর নিনেভেহর প্রাচীন গির্জাগুলোকে বোমা বানানোর কারখানায় রূপান্তর করে আইএস। সিনজার পর্বতমালায় বহু নারীকে যৌনদাসীতে পরিণত করা হয়।

আইএস পরিচিত ছিল আরও বিভিন্ন নামে। আইসিস, আইসিল ও দায়েশ। এটি পরিচালিত হতো বাগদাদির নেতৃত্বাধীন ‘ডেলিগেট কমিটি’র মাধ্যমে। নিজেদের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে ইসলামের বেশ সহিংস এক সংস্করণ চাপিয়ে দিয়েছিল আইএস। বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের অভিযোগে অভিযুক্ত নারীদের পাথর ছুড়ে হত্যা করা হতো। অভিযুক্ত চোরদের হাত কেটে ফেলা হতো। জঙ্গিদের নির্দেশ অমান্য করলে শিরশ্ছেদ করা হতো।

এ ধরণের শাস্তির কিছু কিছু সৌদি আরবেও দেয়া হয়। কিন্তু ইসলামিক স্টেটের বিশেষত্ব ছিলো, তারা তাদের নৃশংস শিরশ্ছেদের ভিডিও বিশ্বব্যাপী প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে সম্প্রচার করতো। কিছু কিছু শাস্তি তারা নিজেরাই আবিষ্কার করে নিয়েছিল, যার কথা ইসলামি বইপুস্তকে কখনই ছিল না। যেমন, জর্দানের একজন পাইলটকে জীবন্ত পুড়িয়ে ফেলা হয়। এই দৃশ্য মাথার ওপর থেকে ধারণ করা হয় ড্রোনের মাধ্যমে। গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের খাঁচার ভেতর ঢুকিয়ে পানিতে চুবিয়ে হত্যা করা হয়। পানিরোধী ক্যামেরার মাধ্যমে ওই ব্যক্তির শেষ নিশ্বাসের ভিডিও ধারণ করা হয়। অনেককে টি-৫৫ ট্যাংক দিয়ে পিষে ফেলে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। কাউকে আবার কসাইখানায় নিয়ে প্রাণীদের মতো জবাই ও টুকরো টুকরো করা হয়েছে।

এমন নিষ্ঠুর শাস্তি সত্ত্বেও, কিছুক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় সেবা দিতে পেরেছিল আইএস। তারা এমন এক রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে ছিল, যার স্বীকৃতি দেয়নি কোনো দেশই। কিন্তু কিছুক্ষেত্রে পূর্বোক্ত রাষ্ট্রের চেয়েও তাদের শাসন কার্যকর ছিল। যেমন, আইএস আয়কর সংগ্রহ করতো। পাশাপাশি, এ-ও নিশ্চিত করেছিল যে, ময়লা-আবর্জনা যেন প্রকৃত অর্থেই পরিষ্কার করা হয়। বিবাহিতরা বৈবাহিক লাইসেন্স পেতো আইএস-এর স্টেশনারি থেকে। তাদের সন্তান হলে তার ওজন সহকারে জন্মসনদ পেতো। এছাড়া পরিবহণ নিবন্ধন সংস্থাও ছিল তাদের।

আইএস যদিও মধ্যযুগের ধর্মীয় শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠার কথা বলছিল, তারা ছিল কার্যত এই সময়ের সৃষ্টি। এই আমলের প্রযুক্তি ইন্টারনেট ব্যবহার করেই বিশ্বব্যাপী হাজার হাজার অনুসারীকে আকৃষ্ট করেছে তারা। এই অনুসারীরা নিজেদেরকে আইএস-এর খিলাফতের ভার্চুয়াল নাগরিক মনে করতেন।

এই সংগঠনের অনুসারী হতে কোনো অনুমতি প্রয়োজন হতো না। বিশ্বের যে কেউ যেকোনো স্থানে আইএস’র পক্ষে হামলা চালাতে পারতো। এ কারণে আইএস ছিল বহুগুণ ভয়ানক। জীবনে যে কখনও প্রত্যক্ষভাবে আইএস’র সংস্পর্শে আসেনি বা সরাসরি আইএস’র কোনো প্রশিক্ষণও পায়নি, সে-ও আইএস’র পক্ষে হামলা চালাতে পারতো। সেই হিসাবে আইএস বিশ্বের হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী। যুক্তরাষ্ট্রের সান বার্নারডিনোর অফিস পার্টিতে হামলা, জার্মানির বড়দিনের বাজারে হামলা, ফ্রান্সের নিস-এ ট্রাক দিয়ে হামলা, শ্রীলংকার চার্চে ইস্টার সানডের দিনে আত্মঘাতী বোমা হামলা- সবই হয়েছে আইএস’র নামে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হামলাকারীরা পেছনে রেখে গেছে রেকর্ডিং বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে করা পোস্ট বা ভিডিও, যেখানে সে/তারা বাগদাদির প্রতি আনুগত্যের কথা বলেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের সন্ত্রাসবিরোধী শাখার সাবেক জ্যেষ্ঠ পরিচালক জোশুয়া গেল্টজার বলেন, ‘আইএস-এর উত্থান ও বিবর্তনের নেপথ্যে এককভাবে সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি হলেন বাগদাদি।’
(রুকমিনি ক্যালিমাচি ও ফালিহ হাসান যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকার সাংবাদিক। আল-বাগদাদিকে নিয়ে তাদের এই অবিচুয়ারি পত্রিকাটিতে প্রকাশিত হয়েছে)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *