কোটিপতি কাউন্সিলর মঞ্জু ছিলেন বাসের কলার বয়

Spread the love

আশির দশকে জীবিকার তাগিদে শূন্য হাতে গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় আসেন বর্তমান কাউন্সিলর ময়নুল হক মঞ্জু। আশ্রয় নেন গোপীবাগে এক আত্মীয়ের বাসায়। এক পরিবহন নেতা ও বড় ভাইয়ের মাধ্যমে সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে বাসের টিকিট কাউন্টারে টিকেট বিক্রির কাজ পান। মাঝে-মধ্যে বাসের প্যাসেঞ্জার ডাকতে ‘কলার বয়’ এর কাজও করেন মঞ্জু। অল্প আয়ে রাজধানীতে তার বেঁচে থাকাই দায়। এসময় স্থানীয় বিএনপিদলীয় এক এমপির সঙ্গে তার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তার দোহাই দিয়ে মঞ্জু সায়েদাবাদ টার্মিনালে চাঁদাবাজি শুরু করেন। কিন্তু রাজনীতির হাওয়া বদল হলে বোল পাল্টিয়ে তিনি ওয়ার্ড কাউন্সিলরের পদ বাগিয়ে নেন। সম্পর্ক গড়েন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতাদের সঙ্গে। এরপর আর তাকে পেছনে তাকাতে হয়নি।

বৃহস্পতিবার (৩১ নভেম্বর) দুপুরে র‌্যাবের একটি দল টিকাটুলি এলাকায় অভিযান চালিয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৩৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মঞ্জুকে তার কার্যালয় থেকে গ্রেফতার করে। তার কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় দুটি পিস্তল, মদ, গাঁজা, ইয়াবা, ফেনসিডিল, যৌন উত্তেজক ওষুধ ও একটি পাসপোর্ট, বেশ কিছু জমির দলিল ও কাগজপত্র। গ্রেফতার করা হয় তার গাড়িচালক সাজ্জাদ হোসেনকেও।

আগের দিন (বুধবার) ওয়ারী থানায় রাজধানী সুপার মার্কেটের ব্যবসায়ী কাজী মো. রনির দায়ের করা মামলার প্রেক্ষিতে এই গ্রেফতার অভিযান চলে। রনির অভিযোগ, কাউন্সিলর মঞ্জু তার কাছে ২ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন এবং ওই টাকা না দেয়ায় বিভিন্নভাবে হুমকি দিয়েছেন।

বৃহস্পতিবার রাতে মঞ্জুর বিরুদ্ধে অস্ত্র ও মাদক আইনে আলাদা দুটো মামলা করেন র‌্যাব-৩ এর নায়েব সুবেদার ইব্রাহিম হোসেন। অস্ত্র মামলায় আসামি করা হয় মঞ্জুকে। আর মাদক মামলায় মঞ্জুর সঙ্গে তার গাড়িচালক সাজ্জাদও আসামি। রাতেই কাউন্সিলর মঞ্জুকে থানায় হস্তান্তর করে র‌্যাব। আজ শুক্রবার দুপুরে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ড চেয়ে তাকে আদালতে পাঠানোর কথা রয়েছে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের গত নির্বাচনে মঞ্জু ওয়ার্ড কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। তার বৈধ কোনো আয়ের পথ নেই। সন্ত্রাস আর চাঁদাবাজিই তার অর্থের উৎস। হাটখোলার বাসায় মঞ্জুর কেউ থাকেন না। স্ত্রী, দুই ছেলে, এক মেয়ে যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। মঞ্জু নিজেও নিয়মিত সেখানে যাতায়াত করেন। মঞ্জু তার চাঁদাবাজির সমস্ত টাকা যুক্তরাষ্ট্রে পাঠাতেন বলে র‌্যাবের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন।

র‌্যাব কর্মকর্তা জানান, কাউন্সিলর মঞ্জু চাঁদাবাজির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা উপার্জন করে সেসব অর্থ যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত পরিবারের কাছে হুন্ডির মাধ্যমে পাচার করেছেন। কী পরিমাণ অর্থ তিনি পাচার করেছেন এটি তদন্তের বিষয়। মঞ্জু নিজেও একজন মাদকসেবী।
র‌্যাব সূত্র জানায়, টিকাটুলীতে ২০১৮ সালের এপ্রিলে আশরাফুল নামে এক ব্যক্তি একটি পেট্রোল পাম্প স্থাপন করতে চেয়েছিলেন। ওই সময় মঞ্জু তার কাছে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন। টাকা না দেয়ায় পেট্রোল পাম্প আর স্থাপন করা হয়নি। ওই ঘটনায় আশরাফুল ওয়ারী থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। সূত্র জানায়, ওয়ারীর টিকাটুলি এলাকায় মঞ্জুর নামে অন্তত তিনটি ফ্ল্যাট দখলের অভিযোগ রয়েছে। এগুলোর বর্তমান বাজারমূল্য পাঁচ কোটি টাকা। ডেমরা ও কদমতলীর দনিয়া এলাকায় চারটি প্লট দখলের অভিযোগও রয়েছে। ওই প্লটে বালু ফেলে তার নামে সাইনবোর্ড টাঙ্গানো হয়েছে।

র‌্যাব-৩ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল শাফিউলাহ বুলবুল জানান, ওয়ার্ড কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার পর মঞ্জু সরকারদলীয় নেতা পরিচয়ে প্রভাব খাটিয়ে শুরু করেন দখলদারি ও চাঁদাবাজি। গড়ে তোলেন নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী। চলমান ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু হওয়ার পর র‌্যাব-৩ এবং র‌্যাবের সদর দফতরে ওই এলাকার একাধিক ব্যক্তি তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। অভিযান শুরু হওয়ার পর তিনি কিছুদিন আত্মগোপনে যান। র‌্যাবের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা তার বিরুদ্ধে তদন্ত অব্যাহত রাখেন।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন থেকে যে ২১ জন ওয়ার্ড কাউন্সিলরকে শোকজ নোটিশ দেয়া হয়েছিল তাদের মধ্যে মঞ্জুও ছিলেন। তিনি ওয়ারি থানা আওয়ামী লীগের সদস্য। এ ছাড়াও তিনি ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের কমিটিতে সদস্য ছিলেন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগে তাকে আওয়ামী লীগের ওই কমিটি থেকে বাদ দেয়া হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *