নাগরিক রিপোর্ট: ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের বিমান হামলায় শুক্রবার ভোরে নিহত হয়েছেন ইরানের শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা জেনারেল কাসেম সুলেইমানি। ইরানি জনগণের পাশাপাশি এই ঘটনার পরিণতি নিয়ে শঙ্কিত পুরো বিশ্ব। ব্যক্তিগত জীবনে সুলেইমানি ছিলেন অত্যন্ত নিভৃতচারী একজন মানুষ। সেই নিভৃতচারী মানুষটাই একসময় হয়ে ওঠেন ‘সবচেয়ে ক্ষমতাধর’ জেনারেল।
সুলেইমানির উঠে আসা ইরানের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের কেরমান প্রদেশের একটি দরিদ্র পরিবার থেকে। তার জন্ম ১৯৫৭ সালে। পরিবারে অর্থনৈতিক সচ্ছলতা আনতে মাত্র ১৩ বছর বয়সে কাজ শুরু করেন তিনি। অবসরে ভারোত্তোলন চর্চা করতেন সুলেইমানি।
১৯৭৯ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ইরানে ইসলামি বিপ্লবের বিজয়ের পর আইআরজিসিতে যোগদান করেন তিনি। সামরিক প্রশিক্ষণ শেষ হওয়ার আগেই মাত্র ছয় সপ্তাহের মধ্যে ইরানের পশ্চিম আজারবাইজান প্রদেশে প্রথম যুদ্ধক্ষেত্রে নামতে হয় তাকে।
ইরান-ইরাক যুদ্ধের (১৯৮০-১৯৮৮) সময় সীমান্তে বীরোচিত ভূমিকার জন্য ‘জাতীয় বীর’ বনে যান সুলেইমানি। এরপর সামরিক বাহিনীতে তিনি হয়ে ওঠেন অন্যতম আস্থাভাজন জেনারেল। এই আস্থাভাজন জেনারেলের হাতে ১৯৯৮ সালে তুলে দেওয়া হয় বিপ্লবী গার্ডের প্রধানের দায়িত্ব। তারপর অনেকটা নিভৃতে তিনি কাজ করতে থাকেন। তার কৌশলের কারণে লেবাননের হিজবুল্লাহ, সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের অনুগত বাহিনী এবং ইরাকের শিয়াপন্থি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক জোরালো হয়।
সুলেইমানির কুদস বাহিনী সাম্প্রতিক সময়ে ইরান সীমানার বাইরে কর্মক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সফলতার পরিচয় দিয়েছে সিরিয়া এবং ইরাকে। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ যখন গৃহযুদ্ধের কারণে পতনের দ্বারপ্রান্তে, তখন সুলেইমানির নেতৃত্বাধীন বাহিনী যুদ্ধক্ষেত্রে কৌশলী ভূমিকা নেয়। এই ভূমিকার কাছে হেরে যায় আসাদ বিরোধী সুন্নি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো। এছাড়া ইরাক ও সিরিয়ার বিশাল অংশে জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস দমনে যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়ার পাশাপাশি সুলেইমানির বাহিনীও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
দীর্ঘদিন নিভৃতে কাজ করলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তাকে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি ও অন্য শিয়া নেতাদের সঙ্গে বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানে দেখা যেতে থাকে। গত বছরের মার্চে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি জেনারেল সুলেইমানিকে ‘অর্ডার অব জুলফিকার’ পদক দেন। বিপ্লব-পরবর্তী ইরানে সুলেইমানিই প্রথম এ পদক পান। সুলেইমানি তার কুদস বাহিনীর কার্যক্রমের বিষয়ে কেবল আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির কাছেই জবাবদিহি করতেন।
সাদ্দাম হোসেনের পতনের পর পশ্চিমাদের তদারকিতে ইরাকে সরকার গঠিত হয়। সে সময় দেশটির রাজনীতিতে নিজের ক্ষমতা বাড়াতে তৎপর হন সুলেইমানি। ইরাকের দুই প্রধানমন্ত্রী ইব্রাহিম আল-জাফরী ও নুরী আল-মালিকীর সময়ে তার তৎপরতা বেশ বাড়ে।
অন্যদিকে ২০১১ সালে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হলে সুলেইমানি তার ছত্রছায়ায় থাকা ইরাকের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর একটি অংশকে বাশারের পক্ষে লড়াইয়ের জন্য পাঠান। সে ক্ষেত্রেও সফলতা পান তিনি। এছাড়া আইএসের বিরুদ্ধে ইরাকের সামরিক বাহিনীর যুদ্ধের সময় তাদের সঙ্গে সশস্ত্র গোষ্ঠী হাশদ আল-শাবিও লড়ে সুলেইমানির নির্দেশনায়।
এই দুই যুদ্ধক্ষেত্রে জেনারেল সুলেইমানির ভূমিকা তাকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যায় ইরানিদের কাছে। ইউনিভার্সিটি অব তেহরানের আমেরিকান স্টাডিজ ডিপার্টমেন্টের প্রধান মোহাম্মদ মারান্দির ভাষায়, ‘আইএসকে পরাভূত করতে ভূমিকার জন্য ইরানি জনগণ ও মধ্যপ্রাচ্যের অন্যদেশগুলোর নাগরিকদের কাছে সুলেইমানি একজন ‘জাতীয় বীর’। তার মতো একজন দায়িত্ব না নিলে এই অঞ্চলে হয়তো আইএসের কালো পতাকা উড়ত।’
সেনাবাহিনীতে যখন থেকে সুলেইমানির প্রভাব চোখে পড়তে থাকে, তখন থেকেই যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের ‘টার্গেটে’ পরিণত হন তিনি। সৌদি ও যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, লেবাননের হিজবুল্লাহ, ফিলিস্তিনের হামাস, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের ‘ফাতেমিয়ুন’ ও ‘জাইনাবিয়ুন’ এবং ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীদের পেছনে বড় শক্তি ইরান। আর ইরানকে এই ভূমিকায় এনেছেন সুলেইমানি। অর্থাৎ সুলেইমানির কারণেই সীমানার বাইরে সামরিক প্রভাব বেড়েছে ইরানের।
শত্রুর চোখে চোখ রেখে চলার নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন জেনারেল সুলেইমানি। তিনি কুদস বাহিনীর মূল কর্মক্ষেত্র ইরানের বাইরে নিয়ে গিয়ে গোটা মধ্যপ্রাচ্যে তেহরানের যে সামরিক প্রভাব তৈরি করেন, তা তাকে দেশে এবং বিদেশে জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বের মর্যাদায় আসীন করেছে।
ইরানে বিপ্লবের পর যুগ যুগ ধরে দেশটির ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে আসছে পশ্চিমারা। এরপরও তেহরান দিনে দিনে মধ্যপ্রাচ্যে যে উত্থানের গল্প লিখেছে, তাতে বড় অবদান এই সুলেইমানির। সামরিক ক্ষেত্রে পরিবর্তন এনে ইরানের অর্থনীতিকে নিশ্চিত পতন থেকে রক্ষা করেছেন তিনি। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইরানের আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী সৌদি আরব ও ইসরায়েল সুলেইমানির তৎপরতা অনুমান করতে পারলেও তাকে থামাতে পারছিল না। গত দুই দশকে সৌদি, ইসরায়েল ও পশ্চিমা কয়েকটি দেশের বিভিন্ন সংস্থা সুলেইমানিকে গুপ্তহত্যার অসংখ্য চেষ্টা চালায়। শেষ পর্যন্ত মার্কিনিদের হামলায় প্রাণ গেল তার। প্রসঙ্গত, শুক্রবার যুক্তরাস্ট্রের রকেট হামলায় সুলেইমানির মৃত্যু হয়। ইরান এমন ঘটনাকে ভয়ংকর কান্ডজ্ঞানহীন বলে মন্তব্য করেছে।