মহারাজা’র প্রত্যাবর্তন

Spread the love

নাগরিক ডেস্ক: বাংলাদেশ ক্রিকেটের অঘোষিত মহারাজা সাকিব আল হাসান। এ দেশের ক্রিকেটের উত্থানে সামনে থেকেই নেতৃত্ব দিয়েছেন এ তারকা অলরাউন্ডার। দেশের গণ্ডি পেড়িয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও নিজেকে পরিচিত করেছেন সুপার স্টার হিসেবে। আইপিএল, ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগ, কাউন্টিসহ বিশ্বের সব জনপ্রিয় টুর্নামেন্টেই দেখিয়েছেন চমক। সেই সাকিবই নিষেধাজ্ঞার কারণে গত এক বছর ছিলেন মাঠের বাইরে।

গত বছরের ২৯ অক্টোবর সাকিব আল হাসান ও বাংলাদেশের সকল ক্রিকেটপ্রেমীদের জন্য ছিল ভুলে যাওয়ার মতো একটি দিন। এ দিনেই সবধরনের ক্রিকেট থেকে এক বছরের স্থগিত নিষেধাজ্ঞাসহ দুই বছরের জন্য নিষিদ্ধ হয়েছিলেন বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান। এরপর থেকেই সাকিবের ফেরার ক্ষণ গণনা শুরু করেন ক্রিকেটপ্রেমীরা। বৃহস্পতিবার চলে এসেছে কাঙ্ক্ষিত সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, শেষ হয়েছে সাকিবের নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ।

মূলত দুই বছরের জন্য নিষিদ্ধ হলেও এক বছর স্থগিত নিষেধাজ্ঞা থাকায় এক বছর পরই খেলায় ফিরতে পারছেন সাকিব। এ অলরাউন্ডারের বিরুদ্ধে তিনটি অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাকে এই সাজা দিয়েছিল বিশ্ব ক্রিকেটের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইসিসি। তিনটি অপরাধেই আইসিসির ২.৪.৪ ধারা ভঙ্গ করেছেন সাকিব।

সাকিবের বিরুদ্ধে প্রমাণিত অভিযোগগুলো হলো:

১. ২০১৮ সালের আইপিএল কিংবা একই বছরের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ, শ্রীলংকা ও জিম্বাবুয়ের মধ্যকার ত্রিদেশীয় সিরিজে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের প্রস্তাব পাওয়ার পরও তা আইসিসিকে না জানানো।

২. একই ত্রিদেশীয় সিরিজে জুয়াড়ির কাছ থেকে দ্বিতীয় একটি অনৈতিক প্রস্তাব পাওয়ার পরও চুপ থাকা এবং সেটা আইসিসির সংশ্লিষ্ট দফতরকে না জানানো।

৩. ২০১৮ সালের আইপিএলে সানরাইজার্স হায়দরাবাদের বিপক্ষে কিংস ইলেভেন পাঞ্জাবের মধ্যকার ম্যাচে ফিক্সারদের কাছ থেকে প্রস্তাব পাওয়ার পরও চুপ থাকা।

এসব অভিযোগের ব্যাপারে আকসুর কাছে দোষ স্বীকার করে নেন সাকিব। তদন্ত শেষে তার বিরুদ্ধে শাস্তি ঘোষণা করা হয়। ফলে দীর্ঘ এক বছর মাঠের বাইরে ছিলেন এ বিশ্বসেরা। আর এ শাস্তিতেই যেন এক বছরের জন্য হারিয়ে গিয়েছিল দেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় নক্ষত্র। বৃহস্পতিবার এ নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ার সাথে সাথে আবারও মাঠে প্রত্যাবর্তনের অনুমতি পেল এ দেশের ক্রিকেটের মহারাজা, ইতিহাসের সেরা ক্রিকেটার।

গত বিশ্বকাপে ব্যাট ও বল হাতে দুর্দান্ত পারফর্ম করে সাকিব নিজেকে নিয়ে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। এছাড়া দেশের জার্সিতেও অসংখ্য ইতিহাস গড়েছেন তিনি। বিশ্বের প্রথম ও একমাত্র ক্রিকেটার হিসেবে তিন ফরম্যাটেই আইসিসির র‍্যাঙ্কিংয়ে এক নম্বর অলরাউন্ডার হওয়ার বিরল কৃতিত্ব অর্জন করেছেন তিনি।

২০০৭ সালে অভিষেক হওয়ার পর এ পর্যন্ত দেশের সাদা জার্সিতে ৫৬টি টেস্ট খেলেছেন সাকিব। এছাড়া ২০৬টি ওয়ানডের পাশাপাশি খেলেছেন ৭৬টি টি-টুয়েন্টি। ১৩ বছরের ক্যারিয়ারে ব্যাট-বল হাতে সমানতালে পারফর্ম করে গেছেন সাকিব, দেশকে জিতিয়েছেন অসংখ্য ম্যাচ।

সেই সাকিবই দীর্ঘ একবছর থাকবেন মাঠের বাইরে তা যেন এদের ক্রিকেট সমর্থকরাও মেনে নিতে পারেনি। আর তাই এ ঘোষণার পর মিরপুরে দেখা গিয়েছিল সাকিব ভক্তদের মিছিল।

গত এক বছরে পূর্ব নির্ধারিত সূচি অনুযায়ী টেস্ট, টি-টুয়েন্টি ও ওয়ানডেসহ সাকিবের ৩৯টি ম্যাচ মিস করার কথা ছিল। কিন্তু প্রাণঘাতী করোনার কারণে থেমে গিয়েছিল বিশ্ব ক্রিকেটই। ফলে মাত্র ৪টি টেস্ট, ৩টি ওয়ানডে ও ৭টি টি-টুয়েন্টি মিস করেছেন সাকিব।

নিষেধাজ্ঞা শেষ হলেও শীঘ্রই মাঠে দেশের জার্সিতে মাঠে নামার সুযোগ পাচ্ছে না বাংলাদেশ। করোনা কারণে আপাতত স্থগিত হয়েছে বাংলাদেশের শ্রীলঙ্কা সফর। এ বছর আর কোনো আন্তর্জাতিক ম্যাচ নেই টাইগারদের। তবে নভেম্বরে কর্পোরেট টি-টুয়েন্টি টুর্নামেন্ট আয়োজন করবে বিসিবি। আর সে টুর্নামেন্টটি দিয়ে প্রত্যাবর্তন করবে এ দেশের ক্রিকেটের মহারাজা।

সাকিবের প্রত্যাবর্তনে সতীর্থদের আবেগঘন পোস্ট:
গত বছরের ২৮ অক্টোবর পেরিয়ে, ২৯ অক্টোবরের প্রথম প্রহর; তখন হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে দেশের বেশিরভাগ মানুষ, বাকিরাও প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ঘুমিয়ে যাওয়ার। তখনই জেগে থাকা মানুষদের হতবাক করে দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলো একটি খবর, যার সারমর্ম ছিল, ফিক্সিংজনিত ইস্যুতে নিষিদ্ধ হতে চলেছেন সাকিব আল হাসান।

সারারাত, পরদিন সকাল পেরিয়ে দুপুর পর্যন্ত চলল এই খবর নিয়ে নানান কানাঘুষা। বিকেল হতেই মিরপুর শেরে বাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়ামে হাজির সাকিব, সঙ্গে ছিলেন বোর্ড প্রেসিডেন্ট নাজমুল হাসান পাপনও। তবে এর আগেই আনুষ্ঠানিক বিবৃতির মাধ্যমে সাকিবকে দুই বছরের জন্য নিষিদ্ধ করে আইসিসি।

তবে আইসিসির অ্যান্টি করাপশন ইউনিটকে তাদের তদন্ত কাজে যথাযথ সহযোগিতা করায় এক বছর স্থগিত করা হয় সাকিবের শাস্তি, ফলে বাকি এক বছর মাঠের বাইরে কাটাতে হয় তাকে। যা শেষ হলো ২০২০ সালের ২৮ অক্টোবর পেরিয়ে ২৯ অক্টোবর আসতেই।

অর্থাৎ এক বছরের শাস্তি ভোগ করে এখন সবধরনের ক্রিকেট খেলার জন্য মুক্ত বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান। আবার তিনি ২৯ অক্টোবর ২০১৯ তারিখের আগের মতো করেই মিশতে পারেন সবার সঙ্গে, খেলতে পারবেন যেকোনো ধরনের ক্রিকেট।

বিশ্বের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডারের প্রত্যাবর্তনে সতীর্থদের আবেগী পোস্ট ঢেউ তুলেছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। মুশফিকুর রহিম থেকে শুরু করে যুব দলের ক্রিকেটাররাও তাকে স্বাগত জানিয়েছেন।

লম্বা একটা পোস্ট দিয়েছেন মুশফিকুর রহিম। বাংলাদেশের দুটি টেস্ট ডাবল সেঞ্চুরির মালিক লিখেছেন, ‘তরুণ বসে আমরা একসঙ্গে ক্যারিয়ার শুরু করেছিলাম এবং কখনও পেছনে তাকাতে হয়নি। গত বছর এটা শুনে খুব বড় ধাক্কা খেয়েছিলাম যে আমরা এক বছরের জন্য আর ড্রেসিংরুম ভাগাভাগি করতে পারবো না। আমাদের কত চমৎকার স্মৃতি, ভালো সময়ে একসঙ্গে ছিলাম এবং কঠিন সময়েও। আমি খুব আনন্দিত যে এক বছর শেষ এবং একসঙ্গে আবার মাঠে নামবো। তুমি সবসময় একজন চ্যাম্পিয়ন হয়ে ফিরে এসেছ এবং তোমার সঙ্গে আরও বেশি বেশি ম্যাচ জয়ী জুটি গড়ার জন্য আর অপেক্ষা সইছে না আমার। ইনশাল্লাহ, একসঙ্গে আমরা দেশের জন্য আনন্দ বয়ে আনবো।’

যুব দলের বিশ্বকাপ জয়ী পেসার শরীফুল ইসলাম লিখেছেন, ‘ওয়েলকাম ব্যাক ‘নবাব’- সাকিব ভাই। বাঁহাতি অলরাউন্ডারের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিকেএসপি লিখেছে, ‘স্বাগতম সাকিব আল হাসান। ইনশাল্লাহ, নবাব আবার শাসন করবে বিশ্ব ক্রিকেট!’

সাকিবের সঙ্গে মাঠে অনুশীলন থেকে ফেরার এক ছবি পোস্ট করে উইকেটকিপার ব্যাটসম্যান নুরুল হাসান সোহান লিখেছেন, ‘ক্রিকেট মাঠে স্বাগতম ভাই। আপনার বাঘের মতো গর্জন দেখতে আর তর সইছে না।’ সাকিবের সঙ্গে উইকেট উদযাপনের ছবি দিয়ে কাটার মাস্টার মোস্তাফিজুর রহমানের পোস্ট, ‘স্বাগতম, সাকিব ভাই।’

টেস্ট ম্যাচে দু’জনের একসঙ্গে ছবি দিয়ে সৌম্য সরকার হার্ট ইমোজি দিয়ে লিখেছেন, ‘স্বাগতম, ভাই।’ সাকিবকে লিজেন্ড উল্লেখ করে লিটন কুমার দাশের পোস্ট, ‘স্বাগতম, লিজেন্ড।’ রেস্টুরেন্টের টেবিলে বসা সাকিব আর ইমরুল কায়েস। এমন এক ছবি পোস্ট করে আঞ্চলিক ভাষায় ইমরুল লিখেছেন, ‘আইয়া পড়ো, সাকিব।’

ওয়ানডে অভিষেকে সাকিবের সঙ্গে তোলা ছবি দিয়ে পেসার মোহাম্মদ সাইফ উদ্দিন লিখেছেন, ‘এটা আমার প্রথম ওয়ানডে সিরিজের তোলা ছবি, আফ্রিকা সফরে। ছোটবেলা থেকেই ওনাদের খেলা দেখেই বড় হয়েছি এবং একপ্রকার আর পাঁচটা দর্শকের মতো আমিও ওনার বিশাল ফ্যান | ইনশাল্লাহ যদি কখনো টেস্ট অভিষেক হওয়ার সুযোগ হয়, আমার ইচ্ছা আছে ওনার কাছ থেকেই টেস্ট ক্যাপটা নেওয়ার। সুস্থভাবে নিরাপদে দেশে ফিরে আসেন ভাই, আবার মাঠে মানুষ মাঠে দেখার অপেক্ষায় রইলাম।’

মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান মোসাদ্দেক হোসেনের পোস্ট, ‘রাজা ফিরেছে, স্বাগতম সাকিব ভাই।’ ‘স্বাগতম ভাই’- লিখেছেন সাব্বির রহমান।

সাকিবকে জীবন্ত কিংবদন্তি আখ্যা দিয়ে মেহেদী হাসান মিরাজের পোস্ট, ‘স্বাগতম, সাকিব ভাই! আবারও একই দলে আপনার সঙ্গে খেলতে অধীর অপেক্ষায়। আপনার মতো জীবন্ত কিংবদন্তির সঙ্গে ড্রেসিংরুম ভাগাভাগি করা অনেক বড় পাওয়া। আপনার কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি এবং এখনও অনেক কিছু শেখার বাকি আছে। আশা করি খুব শিগগিরই বাংলাদেশের জন্য খেলতে পারবো।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *