বিলুপ্তির পথে ১৭০ বছরের ঐতিহ্য বরিশাল পাবলিক লাইব্রেরী

Spread the love

নাগরিক রিপোর্ট : গ্রন্থাগারকে বলা হয় ‘জনতার বিশ্ববিদ্যালয়’। বরিশালের জনতার বিশ্ববিদ্যালয় ‘বরিশাল পাবলিক লাইব্রেরী’ এখন বিলুপ্ত হওয়ার পথে। ১৭০ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হয় এটি। রক্ষকের অভাবে প্রতিষ্ঠানটির ভুসম্পদ দখলের হরিলুট চলছে। পাঠক আসার সব পথ রূদ্ধ করে প্রধান ফটকে তালা দেয়া হয়েছে ১০ বছর আগে। ‘একদা এখানে একটি লাইব্রেরী ছিল’- এমন ইতিহাসের স্বাক্ষী হয়ে দোতালা জরাজীর্ন ভবনটি দাড়িয়ে আছে।

পদাধিকার বলে জেলা প্রশাসক সভাপতি হওয়ায় তিনিই প্রতিষ্ঠানটির প্রধান রক্ষক। ৬ শতাধিক আজীবন সদস্যের বেশীরভাগ নগরীর নামিদামী ব্যক্তি। কিন্ত তারা কেউ প্রতিষ্ঠানটি রক্ষায় কেউ দায়িত্বশীল হননি। এমনকি রক্ষকই ভক্ষক হয়েছেন- এমন অভিযোগ রয়েছে দায়িত্বশীলদের বিরুদ্ধে।
জানা গেছে, গত ১০ বছরে বরিশালে জেলা প্রশাসক থাকা প্রত্যেকে যোগদানের পর কর্মপরিকল্পনায় বলেছেন, ‘বরিশাল পাবলিক লাইব্রেরীকে সংস্কার করে ডিজিটাল লাইব্রেরীতে রূপ দেয়া হবে। তাদের অনেকেই একদিনও পাবলিক লাইব্রেরীতে যাননি।

নগরীর বান্দ রোডে বরিশাল পাবলিক লাইব্রেরী অবস্থিত। ১৯৮৪ সালে নির্মিত দোতালা ভবনটি ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে গেছে। ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠানটি অঘোষিতভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়। তারও কয়েকবছর আগে থেকে পাঠকের সংখ্যা কমতে কমতে দিনে ২-৩ জনে পৌছায়। বর্তমানে কেয়ারটেকার মো. শহীদ জরাজীর্ন ভবনটি পাহাড়া দিচ্ছেন। ১৪ হাজারের বেশী বই রয়েছে লাইব্রেরীতে। যার মধ্যে অনেক দূর্লভ বইও রয়েছে।
রোববার দুপুরে বরিশাল পাবলিক লাইব্রেরীতে গিয়ে দেখা যায়, ৫৮ বছর বয়সী শহীদ লাইব্রেরীর সামনে ঘোরাফেরা করছেন। তিনি ৩৫ বছর যাবত চাকুরী করছেন। একসময়ে লাইব্রেরীয়ানসহ ১০ জনের বেশী কর্মচারী ছিল। এখন শহীদ একাই আছেন।

তিনি জানান, ৪০ টাকা বেতনে চাকুরী শুরু করেছিলেন। পয়ত্রিশ বছর শেষে এখন তার বেতন ৩ হাজার টাকা। সেই টাকাও নিয়মিত পানন না। ভবনটি পাহাড়া দেয়া তার প্রধান দায়িত্ব। সংলগ্ন ডায়াবেটিস হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা লাইবেরীর কয়েকজন প্রবীন সদস্য মাঝে মাঝে এসে বিশ্রাম নেন। তাদের জন্য একটি জাতীয় ও একটি স্থানীয় পত্রিকা রাখা হয়। মুল লাইব্রেরী কক্ষের চেয়ার-টেবিলে ধুলাবালুর স্তুুপ। ভবনের সর্বত্র পলেস্তরা খসে পড়েছে। লাইব্রেরীর ৫৮ শতাংস জমির প্রায় অর্ধেক জেলা প্রশাসক নিয়ন্ত্রিত বরিশাল কালেক্টরেক্ট স্কুলের মধ্যে অন্তভর্’ূক্ত করে ভবন নির্মান করা হয়েছে।

জানা গেছে, ১৮৫৪ সালে বরিশাল পাবলিক লাইব্রেরী স্থাপিত হয় নগরীর প্রাণকেন্দ্র সদর রোড বিবির পুকুর পূর্ব পাড়ে। বর্তমান স্থান বান্দ রোডে স্থানারিত হয় ১৯৮৪ সালে। সেখানে ৫৮ শতাংস জমি বরাদ্ধ ও দোতালা ভবন নির্মান করে দেয়া হয়। ২০০০ সাল পর্যন্ত বরিশালের পাঠকদের প্রধান মিলনকেন্দ্র ছিল এই লাইব্রেরীটি। প্রতিদিন সেখানে গড়ে ৩ শতাধিক পাঠক যেতেন বলে জানিয়েছেন কেয়ারটেকার শহীদ।
দুরবস্থার কারন : এক সময়ে নগরীর ৪টি সিনেমা হলে টিকেট বিক্রিমূল্যের একটি অংশ ও পৌরসভার অনুদান ছিল পাবলিক লাইব্রেরীর আয়ের প্রধান উৎস্য। ২০০০ সালের আগেই ওই আয়েরখাতগুলো ও সদর রোড পুরাতন ভবন থেকে ভাড়া আয়ের উৎস্য বন্ধ হয়ে যায়। এতে প্রতিষ্ঠানটি আর্থিক সংকটে পড়ে।

জানা গেছে, নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়ে পাবলিক লাইব্রেরীর কমিটি গঠনে রাজনৈতিক প্রভাব পড়ে। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী আজীবন সদসদ্যের প্রত্যক্ষভোটে দুই বছর মেয়াদী ১৫ সদস্যের পরিচালনা কমিটি গঠন হবে। জেলা প্রশাসক হবেন পদাধিকার বলে সভাপতি। নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়ে নির্বাচনের পরিবর্তে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের নিয়ে সিলেকশন কমিটি গঠনের রেওয়াজ শুরু হয়। এরপর নির্বাচন ও জৌলুস দুটিই পাবলিক লাইব্রেরী থেকে উধাও হয়ে গেছে। বর্তমানে নামমাত্র একটি এডহক কমিটি আছে বলে জানা গেছে।

এডহক কমিটির অন্যতম সদস্য ও বরিশাল উন্নয়ন ফোরামের আহ্বায়ক কাজী এনায়েত হোসেন শিবলু বলেন, ২০১৪ সালে এডহক কমিটি গঠন হয়। এই কমিটিও কখনও লাইব্রেরীটি চালু বিষয়ে উদ্যোগী হয়নি। তিনি বলেন, পাবলিক লাইব্রেরীর সম্পত্তি বেহাত হচ্ছে।
শিবলুর দেয়া তথ্যমতে, সদর রোডে ১৮ শতক জমির ৬ শতক সিটি করপোরেশনের নির্মিত এনেক্স ভবনের মধ্যে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। ১ শতক নেয়া হয়েছে পাশের একটি মসজিদের মধ্যে। বান্দ রোডের ৫৮ শতক জমির অর্ধেক জেলা প্রশাসক দখল করে কারেক্টরেট স্কুলের ভবন নির্মান করেছেন। সদর রোডের জমিতে থাকা ভবনটি গ্রাস করার চক্রান্ত চলছে। তিনি এসবের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামবেন।

বরিশাল পাবলিক লাইব্রেরীর একাধিকবার সাধারন সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন প্রবীন আইনজীবী অ্যাডভোকেট এস.এম ইকবাল। তিনি সমকালকে বলেন, লাইব্রেরীর ভূসম্পতি আয়বর্ধক সম্পদে পরিনত করা হলে এটি একটি স্বয়ংসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান হবে। এজন্য যোগ্যদের হাতে লাইব্রেরী পরিচালনার দয়িত্ব দিতে হবে।##

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *