জন্মদাতাকে বাবা ডাকতে তুষার অপেক্ষা একযুগ পেরিয়েছে

Spread the love

সুমন চৌধুরী, অতিথি প্রতিবেদক : ‘পাশের বাড়ি বাবারে রোজ দেহি, হ্যার ধারে যাইতে ইচ্ছা করে, বাড়ির ধারে গ্যালে হ্যাগো বাড়ির অন্যরা মারে”। পঞ্চম শ্রেনীর ছাত্রী শিরিন আক্তার তুষা’র (১২) কাছে তার বাবা সম্পর্কে জানতে চাইলে সমকালকে এভাবেই বলে সে। আইনী অধিকার না পাওয়ায় তুষা পিতৃ পরিচয় প্রকাশ্যে বলতে পারেনা। কাছে যেতে পারেনা। কোনদিন পারবে কি-না তাও অনিশ্চিত। আইনীভাবে বাবার পরিচয় পেতে জন্মদাত্রী মা ধর্ষিতা শাহনাজ বেগমকে আদালতে স্বাক্ষ্য দিতে হবে। বাকপ্রতিবন্ধী শাহনাজ স্বাক্ষ্য দিতে না পারায় গত ১২ বছর ধরে তুষার পিতৃ পরিচয়ের মামলাটি নিস্পত্তি করা যায়নি।
বাকপ্রতিবন্ধীর বক্তব্য বুঝিয়ে দেয়ার জন্য বরিশাল নারী ও শিশু নির্যাতন অপরাধ ট্রাইবুনালে নির্ধারিত ইশারাবিদ না থাকায় শাহনাজের স্বাক্ষ্যগ্রহন আটকে আছে কয়েকবছর যাবত। ধর্ষনের ফলে ১২ বছর আগে জন্ম নেয়া শিশু তুষা কৈশোরে পা রাখলেও পিতৃ পরিচয় আদায়ের মামলাটি আদালতে ঝুলছে।
নারী ও শিশু নির্যাতন অপরাধ দমন ট্রাইবুনালের বিশেষ প্রসিকিউটির অ্যাডভোকেট ফয়েজ আহম্মেদ জানান, বাকপ্রতিবন্ধীরা ইশারায় যে বক্তব্য দেন তা বিচারককে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য ইশারাবিদ প্রয়োজনের হয়। বরিশালের আদালতে নির্ধারিত ইশারাবিদ নেই। এ কারনে বাক প্রতিবন্ধীদের স্বাক্ষ্যগ্রহন নিয়ে তাদেরকে চরম সংকটে পড়তে হয়। শাহনাজসহ ধর্ষিতা আও দুই বাকপ্রতিবন্ধী নারীর স্বাক্ষ্যগ্রহন আটকে আছে ইশারাবিদের অভাবে। পিপি জানান, আদালতের বিচারক নিজ উদ্যেগেই ইশারাবিদ খোঁজ করছেন। ফরিদপুর ও খুলনায় দুজন ইশারাবিদের সন্ধানও পাওয়া গেছে। তাদেরকে বরিশালে আনার প্রক্রিয়া চলছে।
শাহনাজের মামলটি পরিচালনা করছেন আইন সহায়তা প্রতিষ্ঠান ব্লাস্ট। এ সংস্থার বরিশালের সমম্বয়ক অ্যাডভোকেট শাহিদা তালুকদার জানান, শাহনাজের বক্তব্য উপস্থাপন করার জন্য ইশারাবিদ চেয়ে স্থানীয় কয়েকটি বাক প্রতিবন্ধী সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে সারা মেলেনি। অন্য বাক প্রতিবন্ধীর মামলাগুলোরও একই অবস্থা। ফলে মামলাগুলো নিস্পত্তি হচ্ছেনা। অ্যাডভোকেট শাহিদা তালুকদার জানান, শাহনাজের মামলার আসামী ধর্ষক মহসিন খান বিত্তশালী হওয়ায় এরই মধ্যে অর্থের জোরে মামলার গতি ঘুরিয়ে ফেলেছে। ফলে এ মামলায় তুষার পিতৃ পরিচয়ও নিশ্চিত করাও অনেকটা কঠিন।
বাকপ্রতিবন্ধী শাহনাজ (৩২) মুলাদী উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকা পূর্ব তয়কা গ্রামের হতদরিদ্র সিরাজুল হক মোল্লার মেয়ে। ২০ বছর বয়সে ২০০৮ সালের ১৫ জানুয়ারী শাহনাজ কুমারী মা হয়েছেন। তখন জন্ম নেয়া শিশু তুষা এখন পূর্ব তয়কা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী।
শাহনাজের বাবা সিরাজুল হক মোল্লা জানান, তাদের পাশের বাড়ির ধর্ণাঢ্য খান বাড়িতে ঝি’র কাজ করতো শাহনাজ। ওই বাড়ির ছেলে তখনকার ৩০ বছর বয়সী যুবক মহসিন খানের লালসার শিকার হয় শাহনাজ।
সিরাজুল মোল্লা জানান, তিনি প্রথমে স্থানীয়ভাবে বিচার চেয়েও না পেয়ে ২০০৭ সালের ১১ নভেম্বর মুলাদী থানায় মহসিন খানের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। ২০০৮ সালের ১৫ জানুয়ারী জন্ম নেয় তুষা। আসামীর অর্থ-প্রভাব-প্রতিপত্তির জন্য তিনি মামলায় এগুতে পারেননি। আদালতে গেলে সরকারপেক্ষর আইনজীবী আদালতের বারান্দা থেকে তাকে ফিরিয়ে দিতেন। পরে ব্লাস্ট ও মহিলা পরিষদের সহায়তা নেন।
সিরাজুল মোল্লার অভিযোগ, তুষার পরিচয় নিশ্চিত হতে আদালতের নির্দেশে দুইবার ডিএনএ ডেষ্ট করানো হলেও অর্থের জোরে মহসিন খান একই চিকিৎসক দিয়ে তার পক্ষে প্রতিবেদন এনেছেন। টাকার বিনিময়ে স্বাক্ষীদের পক্ষে নিয়েছেন। এমনকি তিনি নিজ উদ্যেগে ইশারাবিদ নিয়ে আদালতে গেলেও আদালতের পুলিশ ভয়ভীতি দেখিয়ে ফিরিয়ে দেয়। দুই লাখ টাকার বিনিময়ে আসামীর সঙ্গে মিলে যাবার জন্য পিপি অ্যাডভোকেট ফয়েজ আহমেদ তাকে টাকার প্রস্তাব দিচ্ছেন। তবে অ্যাডভোকেট ফয়েজ এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
মামলা পরিচালনাকারী এপিপি নাজমা বেগম শিউলি বলেন, স্বাক্ষীরা প্রভাবিত হয়ে প্রথমে আসামী মহসিন খানের পক্ষে স্বাক্ষ্য দিলে বাদীর আপত্তিতে পূনরায় স্বাক্ষ্য নেয়া হয়েছে। ডিএনএ টেষ্ট মহসিন খানের পক্ষে হওয়ায় এটিও নিয়েও সন্দিহান এ আইনজীবী।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ বরিশাল জেলার সহ সাধারন সম্পাদক প্রতিমা সরকার বলেন, বাকপ্রতিবন্ধী তরুনী শাহনাজ ধর্ষিতা হয়ে সন্তান জন্মদানের পর ১২ বছরে সন্তানের পিতৃপরিচয় পাচ্ছেনা ধর্ষক বিত্তশালী হওয়ায়। তার সংগঠনের পক্ষ থেকে এ তরুনীকে সহায়তা দেয়া হয়েছে। আদালতের কাছে এর ন্যায় বিচার দাবী করেছেন এ নারী নেত্রী।##

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *