‘সেদিন আকাশও কেঁদেছিল’

Spread the love

বিভুরঞ্জন সরকার,জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

১৯৮১ সালের ১৭ মে। রবিবার। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের লালচোখ উপেক্ষা করে দেশে ফিরে এসেছিলেন শেখ হাসিনা। তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা। আওয়ামী লীগের নবনির্বাচিত সভাপতি। ১৯৮১ সালের ১৪-১৬ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনে দলের ঐক্য ধরে রাখার বৃহত্তর প্রয়োজনে বাধ্যতামূলক নির্বাসনে থাকা শেখ হাসিনাকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়েছিল।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নির্মম হত্যাকাণ্ডের দিন শেখ হাসিনা এবং তার ছোট বোন শেখ রেহানা দেশের বাইরে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান। ১৫ আগস্ট তারা দেশে থাকলে তাদেরও পরিবারের অন্য সদস্যদের মতো পরিণতি বরণ করতে হতো। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল একটি সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক লক্ষ্য ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য। ঘাতকচক্র এবং তাদের দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মদদদাতা ও পৃষ্ঠপোষকরা মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে উল্টো ধারায় নিতে চেয়েছে। তারা প্রাথমিকভাবে সফলও হয়েছে। যে পাকিস্তানি ধারাকে পরাজিত করে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়, সেই পরাজিত ধারায় দেশকে নিয়ে যাওয়াই ছিল ঘাতক এবং তাদের মুরব্বিদের লক্ষ্য। বঙ্গবন্ধু হত্যার ছয় বছর পর শেখ হাসিনার দেশে ফিরে আসা ছিল ওই খুনিচক্রের বিরুদ্ধে প্রথম কার্যকর প্রতিবাদ। সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের বজ্রমুঠি শিথিল হওয়ার রাজনৈতিক বাস্তবতার শুরু।

শেখ হাসিনাকে বহনকারী বিমান যখন ঢাকার মাটি স্পর্শ করে তখন আকাশ ভেঙে নেমেছিল বৃষ্টি। বিমান থেকে মাটিতে নেমে শেখ হাসিনা কান্না থামাতে পারেননি। আবেগ তাড়িত হওয়াই ছিল তার জন্য স্বাভাবিক। একদিকে আকাশের কান্না, আর একদিকে শেখ হাসিনার কান্নাÑ দুইয়ে মিলে গ্লানি মোচনের এক বিশেষ মুহূর্ত তৈরি হয়েছিল।

মুজিব যে রাষ্ট্রটির জন্ম দিয়েছিলেন, সেই রাষ্ট্র তার জীবন রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে। মুজিবের হাতে গড়া দল, আওয়ামী লীগ, যে দল মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছে, সে দলটিও মুজিব-হত্যার আকস্মিকতায় ছিল হতবিহ্বল। তারাও কোনো কার্যকর প্রতিবাদ-প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক শক্তির সম্মিলিত ব্যর্থতা খুনিদের উল্লাস নৃত্য দেখতে বাধ্য করেছিল গোটা জাতিকে।
নেতার লাশ যখন রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় ৩২ নম্বরের সিঁড়িতে পড়ে ছিল, তখন তারই অনুসারীরা চরম কাপুরুষতা দেখিয়ে নতুন মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে শপথ নিয়েছে। তার পর নানা ঘটনাধারায় সময় গড়িয়েছে। উত্থানপতন চলেছে ক্ষমতা দখলকারীদের মধ্যেও। জেলখানায় চার নেতাকে হত্যা করে আওয়ামী লীগকে মূলত নেতৃত্বশূন্য করা হয়েছিল। হতোদ্যম, হতবল আওয়ামী লীগ আবার সংগঠিত হোক, শক্তি অর্জন করুক, সেটাও চায়নি ক্ষমতা দখলকারীরা।

দেশের রাজনীতি যখন চরম এক অনিশ্চয়তার মুখে, জাতির পতাকা যখন খামচে ধরেছে পুরনো শকুন- ঠিক সেই সময় আওয়ামী লীগের হাল ধরলেন শেখ হাসিনা। যার রক্তে বহমান শেখ মুজিবের রক্ত। তিনি দলের নেতৃত্ব নেওয়ায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে যে আবেগ ও উচ্ছ্বাস তৈরি হয়, তা আরও বেগবান হয় এক বৈরী পরিবেশে দেশে ফিরে আসায়।

শেখ হাসিনা যাতে দেশে ফিরে আসতে না পারেন, তিনি যাতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব নিতে না পারেন, তার জন্য নানা ঘোট পাকানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন জিয়া এবং তার সাঙ্গোপাঙ্গরা। শেখ হাসিনার সাহস ও দৃঢ়তার কাছে পরাভূত হয়েছে ষড়যন্ত্রকারীরা। আওয়ামী লীগের মধ্যেও বিভীষণ ছিল, ছিল মোশতাকের প্রেতাত্মা। কিন্তু তারা সুবিধা করতে পারেননি শেখ হাসিনা এবং তৃণমূল পর্যায়ের মুজিবভক্তদের জীবনপণ ঘুরে দাঁড়ানোর প্রতিজ্ঞার কাছে।

১৯৮১ সালের বৃষ্টিস্নাত ১৭ মে শেখ হাসিনাকে বরণ করার জন্য জনতার ঢল নেমেছিল। যারা পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে হারিয়ে দুফোঁটা চোখের জল ফেলতে পারেননি, তারা ১৭ মে অকাতরে চোখের জল ঢেলে দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করেছিলেন যেন। শেখ হাসিনার দেশে ফেরার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতেও তাৎক্ষণিকভাবেই তৈরি হয়েছিল পরিবর্তনের অভিঘাত। মুক্তিযুদ্ধের হারানো চেতনাকে ফিরিয়ে আনার রাজনীতি বলবান হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল।

শেখ হাসিনা বাবার মতো রাজনীতিতে সাফল্য দেখাতে পারবেন কিনা তা নিয়ে শুরুতে কারও কারও মধ্যে সংশয় ছিল। রাজনীতি থেকে যিনি নিজেকে পিতার ইচ্ছায় দূরে সরিয়ে নিয়েছিলেন, তিনি পিতার রাজনীতির ধারা এগিয়ে নিতে পারবেন কিনা সে প্রশ্নও ছিল। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই শেখ হাসিনা প্রমাণ করতে সক্ষম হন যে, তার ধমনিতে শেখ মুজিবের রক্ত বহমান, তাই তিনি পরাজয় মানতে জানেন না।

যারা ভেবেছিলেন বাংলাদেশে মুজিব হত্যার বিচার হবে না, আওয়ামী লীগ আর কোনো দিন ক্ষমতায় আসতে পারবে না, মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ বিরোধিতাকারীদের বিচার হওয়া সম্ভব নয়, তাদের ভুল প্রমাণ করেছেন শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কৌশলের কাছে আর সবাই পরাজিত হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু যেমন তার সময়ের অন্য সব রাজনীতিকদের ছাড়িয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিলেন, শেখ হাসিনাও তেমনি তার সময়ে তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছেন। কাজটি অবশ্যই সহজ ছিল না। ঘরে-বাইরে বৈরিতা ছিল এবং আছে। সব মোকাবিলা করে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার এক কৃতিত্ব শেখ হাসিনার।

বাংলাদের রাজনীতিতে অনেক নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন শেখ হাসিনা। রাজনীতিবিদরা সাধারণ ফাঁকা প্রতিশ্রুতি দিতে অভ্যস্ত। ক্ষমতার বাইরে থেকে যা বলেন, ক্ষমতায় গিয়ে তা করেন না। কিন্তু শেখ হাসিনা এখানে উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। তিনি যা বলেন তা করেন। চাপ দিয়ে, আন্দোলনের নামে সহিংসতা চালিয়ে শেখ হাসিনাকে নমনীয় করা যায় না। তিনি যেটা সঠিক মনে করেন, সেটা বাস্তবায়িত করার জন্য যে যে পদক্ষেপ নেওয়া দরকার তিনি তা নিতে পিছপা হন না। তার গৃহীত পদক্ষেপ সবাইকে নিশ্চয়ই খুশি করে না। রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত সমাজে রাজনীতিতে একমত একপথ হয়ে চলা সহজ নয়।

তবে শেখ হাসিনার হাত ধরে রাজনীতিতে অস্থিরতা অনেকটাই দূর হয়েছে। শেখ হাসিনাকে যদি সময় ও সুযোগ দেওয়া যায় তা হলে তিনি সত্যিকার অর্থেই বাংলাদেশকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে সক্ষম হবেন । তিনি চারবার দলকে ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করে তার রাজনৈতিক কৌশলের সক্ষমতার প্রমাণ দিয়েছেন। রাজনীতি মূলত নীতি ও কৌশলের খেলা। কৌশলে তিনি শতভাগ জিতেছেন। এখন নীতির রাজনীতি প্রতিষ্ঠায় তার সাফল্য দেখার অপেক্ষায় দেশের মানুষ। করোনা ভাইরাস এক অযাচিত চ্যালেঞ্জ হয়ে সামনে এসেছে, তার পরও আশা, যিনি পারেন, তিনি সব বিপদ-দুর্যোগই মোকাবিলা করতে পারেন। স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে শেখ হাসিনার সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *