সৈয়দ জুয়েল: চাঁদনী রাতের ধবধবে জোছনায় কোথায় যেন আজ নিঁশুতি রাতের গভীর অন্ধকারের শিওরে ওঠা ভয়ের এক ফালি বিষন্নতায় ডুবে আছে পুরো পৃথিবী। পৃথিবীর প্রতিটি অলি গলিতে আজ যেন বিবর্ন স্বপ্নেরা ঘোরাফেরা করে শুভ্র কাপড়ে জড়ানো একাকী ঘরের আমন্ত্রনে। বিশ্ব মৃত্যুর এত ভয়ে ভীত হয়নি আগে কখনো। পাড়া পড়শী, বন্ধু, বান্ধব, আপনজন দেখলেও যেন মৃত্যু দূতের কথা স্নরনে স্বাভাবিক জীবন থেকে অনেক দূরে ভালবাসার মানুষগুলো। দ্রুত বড় অচেনা হয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর মানবজাতি।
অসহায়ত্ব যেন আঁকড়ে ধরছে মায়া মমতায় ঘেরা পারিবারিক সম্পর্ককেও। এক বাড়ীর মানুষের স্বাভাবিক মৃত্যু হলেও করোনার ভয়ে দরজা বন্ধ করে পাশের ঘরের মানুষরাও। মনুষ্যত্বের উজ্বল নক্ষত্রগুলো যেন খসে পরছে সমাজের প্রতিটি বাঁকে। সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকার আনন্দের মূল্য আমরা বুঝিনি আগে,করোনা এসে বুঝিয়ে দিল এর সাতকাহন। সবুজ ঘাসে পা ফেলতেও ভয়, কারো সাথে অনেকক্ষন দাঁড়িয়ে থাকতেও ভয়। পৃথিবীর পরমানু শক্তিধর রাস্ট্রগুলোতেও আজ করোনার শক্তির কাছে পরাজিত। মোড়ল রাস্ট্রগুলোর চোখে আজ নিজেদের বাঁচিয়ে রাখার আঁকুতি। বেঁচে থাকাটাই যেন আজ বড় এক জয় হয়ে খেলা করে করোনার খেলার মাঠে।
খেলার শেষ বাঁশি কখন বাজবে,আমরা কেউ-ই জানিনা। কিছুদিন আগেও মৃত বাড়ীর দিকে সবাই আবেগ, ভালবাসা, মমতা দিয়ে তাকিয়ে থাকতো- আহা! বড় ভাল মানুষ ছিল বলে নিজের নিঃশব্দ মনে কাঁপন ধরে দু ফোঁটা অশ্রু ঝরে পরতো। এখন মৃত বাড়ীর পুরো পরিবারদেরকেই সন্দেহের চোখে দেখে মানুষ। চোখে মুখে অস্বস্তির বহিঃপ্রকাশে জানান দেয়- করোনায় আক্রান্ত হয়ে যেন পুরো পরিবারটিই বড় এক পাপ করে ফেলেছে।
মৃত ব্যাক্তির পরিবারও এ বঞ্চনা এড়াতে যত দ্রুত সম্ভব দাফন শেষ করেন নীরবে নিভৃতে। মনে হয় যত দ্রুত মাটি চাপা দিবে, তত দ্রুতই চাপা পরবে উৎসুক জনতার বিদ্রুপ হাসি। ক’দিন আগেও মসজিদের মাইকে শোনা যেত- একটি শোক সংবাদ, আমরা অতি দুঃখের সহিত জানাচ্ছি যে—! আর এখন পীনপতন নীরবতা। কে মারা গেল প্রকাশ করতে গিয়েও দ্বিধা দ্বন্দ্বের বেড়াজালে আটকে যায় বিমর্ষ কন্ঠস্বর। করোনার আগমনে ভালবাসার চৌকাঠে ঘুনে ধরে বেশ নরম হয়ে যাচ্ছে। সম্পর্কের শেকলে এখন স্থবিরতার ডান্ডা বেড়ি। নিস্পলক করুন চাহনিতে বিপর্যয় মায়া মমতার রং, রুপ, গন্ধ।
করোনার এ হিংস্র রুপ হয়তো বেশীদিন আর থাকবেনা, কিন্তু যে মানবিক বিপর্যয় ঘটেছে পুরো সমাজ ব্যাবস্থার উপরে, তার দগদগে ক্ষত শুকাতে অপেক্ষা করতে হবে বহুদিন। আমরা দ্রুত ফিরে যেতে চাই আমাদের শৈশবের সেই দুরন্তপনা আর মায়ের আঁচলের মিস্টি ঘ্রানমাখা দিনগুলোয়। আরো যেতে চাই- বাদল দিনের প্রথম বরষায় কদম ফুলের শুভ্রতায় ভরা সুরেলা সেই দিনগুলোতে।
টিনের চালে ঝুম বৃস্টি আর ফিনিক জোছনায় প্রিয়জনদের মুখ দেখে আমরা কাটাতে চাই আরো অনেকটা সময়। সুস্থ জীবনে ফিরে স্বাভাবিক মৃত্যুর পরে শুভ্র কাপড়ে প্রিয়জনের একটু স্পর্শের সাথে একটু আতর, লোবান , আর গোলাপ জলের ঘ্রান। যে ঘ্রানে মনুষ্য হ্রদয় একটু বিচলিত হয়ে অশ্রুভেজা নয়নে শেষ বিদায় দিবে। আমরা সেই শেষ বিদায়ের অপেক্ষায়।
২০২০-০৬-১১