বরিশাল আদালত অঙ্গনে টাউট-দালাল প্রতারকদের উৎপাত

Spread the love

পুলক চ্যাটার্জি, অতিথি প্রতিবেদক : অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট গৌরনদী আমলী আদালতে বিচারাধীন একটি যৌতুক মামলার বাদী-বিবাদীর মধ্যে স্থানীয়ভাবে সমঝোতা হয়। ওই বাদী-বিবাদী পক্ষকে ডেকে অন্য একটি আদালতের পেশকার (সরকারী কর্মচারী) তার পছন্দের আইনজীবীর মাধ্যমে মামলাটি আদালতে নিস্পত্তির উদ্যেগ নেন। বিষয়টি জানতে পারেন বাদী-বিবাদী পক্ষের নিযুক্ত আইনজীবীরা। তারা বরিশাল জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি-সাধারন সম্পাদককে অবহিত করলে পেশকারের এ অনৈতিক কাজ তারা বন্ধ করে দেন।
উজিরপুর আমলী আদালতে বিচারাধীন একটি ফৌজদারী মামলার প্রধান আসামীর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি এবং আসামীকে গ্রেফতার করানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে বাদীপক্ষের কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকা নেন আইনজীবী সহকারী (মহুরী) আমির হোসেন। কিন্ত আমীর হোসেন প্রতিশ্রুত ওই কাজ করতে পারেননি। আবার টাকা ফেরত দেয়া নিয়েও তালবাহান শুরু করেন। বাদী এ বিষয়ে নালিশ জানান আইনজীবী সমিতিতে। আইনজীবী সমিতি উদ্যেগ নিয়ে আমির হোসেনের কাছ থেকে ওই টাকা আদায় করে দেন বাদী পক্ষকে।
উপরোক্ত দুুটি ঘটনাই সম্প্রতি ঘটেছে বরিশাল আদালত অঙ্গনে। বরিশাল জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারন সম্পাদক অ্যাডভোকেট কাইয়ুম খান কায়সার উল্লেখিত দুই অনৈতিক ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, ওই পেশকারের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানানো হয়েছে। আইনজীবী সহকারী ক্ষমা প্রার্থনা করায় এবং এটি তার প্রথম অপরাধ হওয়ায় তাকে বরখাস্ত করা হয়নি। তবে আমির হোসেনকে ভবিষ্যতের জন্য সতর্ক করা হয়েছে।
বরিশাল আদালত অঙ্গনে দালাল-টাউটদের উৎপাত ও আইনজীবী সহকারী এবং বিভিন্ন আদালতে কর্মরত জিআরও, পেশকার, সেরেস্তাদার, জারিকারক ও অফিস সহকারীসহ আদালত সংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের অনৈতিক কর্মকান্ড বেড়ে যাওয়ায় জেলা আইনজীবী সমিতি সম্প্রতি এক নোটিশ জারি করেছে। ওই নোটিশে উল্লেখিতদের কেউ কোন অনিয়ম করলে অথবা বিচারপ্রার্থী মানুষদের হয়রানি বা তাদের কাছে কোন অনৈতিক দাবী করলে তা আইনজীবী সমিতিতে অভিযোগ দিতে বলা হয়েছে। নোটিশে আদালত প্রাঙ্গন টাউট ও তদবিরবাজ মুক্ত রাখতে সকল আইনজীবীদের সহযোগীতা চাওয়া হয়েছে।
জেলা আইনজীবী সমিতির একাধিক প্রবীন সদস্য অভিযোগ করেন, আদালতের কর্মচারী এবং আইনজীবী সহকারীরাই নয় বরং বরিশাল আদালত অঙ্গনে শিক্ষানবীশ আইনজীবীরাও বিধি বহির্ভূত কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়েছেন। অভিযোগ করা হয়েছে, কিছু শিক্ষানবীশ আইনজীবী আছেন যারা বিচার প্রার্থীদের কাছে নিজেদের আইনজীবী পরিচয় দিয়ে প্রতারনা করেন। যেমন- তারা বার কাউন্সিলের বিধি উপেক্ষা করে ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে মামলা শুনানী করেন। যা সম্পুর্ন অবৈধ। সম্প্রতি এরকম কাজ করতে গিয়ে ২০-২৫ জন শিক্ষানবীশ আইনজীবী ধরাও পড়েছেন। শুধু ম্যাজিষ্ট্রেট আদালত নয়, সহকারী সাব জজ আদালতেও এমন ঘটনা ঘটে।
এ অভিযোগের বিষয়ে জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারন সম্পাদক অ্যাডভোকেট কাইউম খান কায়সার বলেন, শিক্ষানবীশ আইনজীবীদের বিধিবহির্ভূত কর্মকান্ড প্রতিরোধ করতে মঙ্গলবার (৮/০৯/২০২০) সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট আফজালুল করীম ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দকে সঙ্গে নিয়ে তিনি সকল বিজ্ঞ ম্যজিষ্ট্রেট ও সহকারী সাব জজ আদালত ঘুরেছেন। আদালতগুলো ঘুরে শিক্ষানবীশ আইনজীবীদের এজলাসে না যাওয়ার অনুরোধ করেছেন। তিনি বলেন, শিক্ষানবীশ আইনজীবীরা যাতে এজলাসে মামলা উপস্থাপন করতে না পারেন সেজন্য তাদের আইনজীবী সমিতির লোগো সম্বলিত লাল টাই ব্যবহার করতে বলা হয়েছে। আদালত চলাকালে তারা এজলাসে প্রবেশ করতে পারবেন না।
বিচারপ্রার্থীদের প্রভাবিত-অথবা প্রতারিত করতে আইনজীবী সহকারী বেল্লাল খান সম্প্রতি সকল আদালত অঙ্গনে তার প্রচার ব্যানার টানিয়েছিলেন। বিষয়টি অনৈতিক হওয়ায় আইনজীবী সমিতির নির্দেশে বেল্লাল খান তার ওই ব্যানার অপসারন করতে বাধ্য হন। অ্যাডভোকেট কাইউম খান কায়সার জানান, আইনজীবী সমিতির নেতৃবৃন্দের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে বেল্লাল ভবিষ্যতে এমন কাজ না করার অঙ্গীকার করলে তাকে ক্ষমা করা হয়।
বরিশাল আদালত অঙ্গন টাউট ও তদবিরবাজ মুক্ত রাখতে এবং হয়রানি-প্রতারনা বন্ধ করতে জেলা আইনজীবী সমিতি সচেষ্ট রয়েছে জানিয়ে অ্যাডভোকেট কাইউম খান কায়সার বলেন, দালালী ও প্রতারনা বন্ধে লাইসেন্সধারী আইনজীবী সহকারীদের নির্দিষ্ট পোশাক পড়ে আদালতে আসার বিধান করা হচ্ছে। তাছাড়া আদালতের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানানো হয়েছে সতর্ক দৃষ্টি রাখার জন্য।
জেলা আইনজীবী সমিতির প্রবীন একাধিক সদস্য অভিযোগ করেন, কিছু সরকারি কর্মচারী, আইনজীবী সহকারী এবং দালালরা বিচারপ্রার্থীদের সরলতার সুযোগ নিয়ে তাদের সঙ্গে আর্থিক চুক্তি করেন। কিন্ত তাতে বিচারপ্রার্থীর কোন লাভ হয়না। বরং হয়রানি ও আর্থিক ক্ষতির শিকার হন। এদের উৎপাতে আইনজীবীদের ভাবমূর্তিও ক্ষুন্ন হচ্ছে। প্রবীন ওই আইনজীবীদের মতে, নারী নির্যাতন, হত্যা, মাদক, বিশেষ ক্ষমতা আইন ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে দায়ের হওয়া মামলায় বিচার প্রার্থীরা বেশী প্রতারিত হচ্ছেন।
জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট আফজালুল করীম বলেন, বরিশাল আদালত অঙ্গন কলুষমুক্ত করতে প্রতারনা- হয়রানি এবং জাল-জালিয়াতির সঙ্গে যারা জড়িত রয়েছে তাদের উচ্ছেদের উদ্যেগ নেয়া হয়েছে। জিআরও-পেশকারসহ আদালত সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধেও বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। যা সম্প্রতি বিজ্ঞ বিচারকদের অবহিত করা হয়েছে। বিচারকরাও সহযোগীতার আশ্বাস দিয়েছেন।
বিচার বিভাগীয় কর্মচারী সমম্বয় পরিষদ বরিশাল জেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক এস.এম হেদায়েতুন নবী জাকির বলেন, আদালত অঙ্গনে টাউট-দালালদের কারনে বিচার বিভাগীয় কর্মচারীদের বদনাম হচ্ছে। তাই আমরাও চাই আদালত অঙ্গনে সব ধরনের অনৈতিক কর্মকান্ড বন্ধ হোক।
বরিশাল আইনজীবী সহকারী (মহুরী) সমিতির সভাপতি শরীফ মো. আনিসুর রহমান বলেন, জেলা আইনজীবী সমিতির উদ্যেগের সঙ্গে তারা একমত। নির্দিষ্ট পোশাক পড়ে এবং পরিচয়পত্র গলায় ঝুলিয়ে আইনজীবী সহকারীদের কাজ করতে হবে। ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে যারা লাইসেন্স নবায়ন করবেন না তারা আইনজীবী সহকারী হিসাবে আদালতে কাজ করতে পারবেন না।##

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *