ভোলায় গ্যাস ফিল্ড ইজারার পায়তারা!

Spread the love

নাগরিক ডেস্ক:
ভোলার শাহবাজপুর গ্যাস ফিল্ড বিদেশিদের হাতে তুলে দিতে গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। সিলেট অঞ্চলের পর গ্যাসের সবচেয়ে বড় রিজার্ভ ধারণা করা হচ্ছে উপকূলীয় এই অঞ্চলটিতে।

সম্ভাবনাময় এই গ্যাস ফিল্ডটির ওপর শকুনের নজর অনেক আগে থেকেই। কিন্তু বাপেক্সের কয়েকজন সাহসী কর্মকর্তার কৌশলী ভূমিকায় সে যাত্রায় ভেস্তে যায় মহাপরিকল্পনা। রক্ষা পায় সম্ভাবনাময় শাহবাজপুর গ্যাস ফিল্ড। কৌশলী বাপেক্স কর্তারা আওয়ামী লীগ সরকারের গৃহিত সেই প্রকল্প (শাহবাজপুর গ্যাস ফিল্ড মূল্যায়ন ও উন্নয়ন) যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হন। ২০০০ সালে কেবিনেটে অনুমোদিত ওই প্রকল্পটি ছিল একটি ঐতিহাসিক প্রকল্প, যা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনুমোদন দিয়েছিলেন প্রথা ভেঙে। বাপেক্স উৎপাদন ও উন্নয়ন কোম্পানি হলেও গ্যাস ফিল্ডটির স্বার্থে গ্যাস উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী সেই দূরদর্শী সিদ্ধান্তের সুফল পাচ্ছে আজকের বাংলাদেশ। ওই অনুমোদনের পর বাপেক্স মাত্র ৮১ কোটি টাকায় ১’শ একর জমি অধিগ্রহণ ৩৫’শ মিটার কূপ খনন, একটি কূপের ওয়ার্কওভার, ৫২ কিলোমিটার পাইপলাইন (ট্রান্সমিশন ৩৩ কিলোমিটার ও ডিস্ট্রিবিউশন ২০ কিলোমিটার) স্থাপন, অস্থায়ী প্রসেস প্লান্ট স্থাপন, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য আবাসনের ব্যবস্থা করেন। সেই প্রকল্পটি বাতিল করে গ্যাস ফিল্ডটি আমেরিকান কোম্পানি ইউনোকলকে দিতে চেয়েছিল বিএনপি। যে প্রক্রিয়া এক সময় সবচেয়ে বড় রিজার্ভ বিবিয়ানাকে শেভরনের হাতে তুলে দেওয়া হয়। যেখান থেকে চড়া দামে গ্যাস কিনতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। অথচ নিজেরা উন্নয়ন করতে পারলে অনেক সাশ্রয়ী মূল্যে গ্যাস পাওয়া সম্ভব হতো।

শেভরনকে যখন কাজ দেওয়া হয় তখন দেশের আর্থিক ও কারিগরি অবস্থা বিবেচনা করলে কিছুটা যুক্তি থেকে যায়। ভূতত্ত্ববিদ অধ্যাপক বদরুল ইমাম মনে করেন বর্তমান অবস্থায় এমন একটি সম্ভাবনাময় গ্যাস ফিল্ড ইজারা দেওয়া হলে তা হবে আত্মহত্যার সামিল।

ফিল্ডটি বাপেক্স আবিষ্কার করে সফলতার সঙ্গে গ্যাস উত্তোলন করে যাচ্ছে। এক সময় সেখানে গ্যাসের গ্রাহক ছিল না তারা নিজের জমি দিয়ে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে সহায়তা করেন। গ্যাজপ্রম এই পুরো ফিল্ডটি পিএসসি (উৎপাদন বন্টন চুক্তি) করতে চায়। ২০১৭ সালে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রাশিয়া সফরে একটি এমওইউ করা হয়। সেখানে বাংলাদেশের গ্যাস সেক্টরে বিনিয়োগ করার কথা বলা হয়। এরপর ২০১৯ সালে বাপেক্সের সঙ্গে পৃথক একটি এমওইউ স্বাক্ষর করে।

শাহবাজপুর গ্যাস ফিল্ড নিয়ে তারা গোপনে কাজ শুরু করেছেন। তাতে মদদ যোগাচ্ছে বাপেক্স, পেট্রোবাংলা ও জ্বালানি বিভাগের চিহ্নিত কয়েকজন কর্মকর্তা। তবে এ বিষয়ে বাপেক্স, পেট্রোবাংলা কিংবা মন্ত্রণালয় কেউই মুখ খুলতে নারাজ।

একটি সূত্র জানিয়েছে, গ্যাজপ্রম পুরো ফিল্ডের মূল্যায়ন করার উদ্যোগ নিয়েছে। সেখানে সাইচমিক সার্ভের পাশাপাশি কূপ খনন করে ডাটা বিশ্লেষণ করতে চায়। অন্যান্য কোম্পানি তাদের নিজেদের খরচে এসব কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে থাকে। আর গ্যাজপ্রম এর আগেও দু’টি কূপ খননের জন্য প্রায় চারগুণ মূল্য হাতিয়ে নিয়েছে। বাপেক্সের রেডি করা তিনটি কূপ খননের জন্য চড়া দর প্রস্তাব প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

ওই তিনটি কূপ খনন করার জন্য বাপেক্স নিজে ভূমি অধিগ্রহণ শেষ করে সেখানে সড়ক নির্মাণ থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। তারা কূপ খনন করলে সর্বোচ্চ দেড়’শ কোটি টাকা খরচ হতো। সেই কাজ প্রায় ৬’শ কোটিতে দেওয়ার প্রক্রিয়া অব্যাহত। ওই কূপগুলো খননের প্রস্তাবের বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিংয়ের জন্য প্রেরণ করা হলে তারা অবজারভেশনসহ মতামত দিয়েছে। শিগগিরই ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভায় উঠতে যাচ্ছে।

রাশিয়ান গ্যাজপ্রম বলে যাকে কাজ দেওয়া হচ্ছে এই গ্যাজপ্রম আসলে রাশিয়ার নয়। এই গ্যাজপ্রম নেদারল্যান্ড ভিত্তিক কোম্পানি। রাশিয়ান গ্যাজপ্রম একটি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কোম্পানি, বিশ্বে কোথাও কূপ খনন করার রেকর্ড নেই। তারা ব্লক ইজারা নিলে অন্যদের দিয়ে কূপ খনন করিয়ে নিয়ে থাকেন। নেদারল্যান্ডের গ্যাজপ্রম কাজটি নিয়ে এরিয়ালকে দিয়ে করাচ্ছে।

ভোলা অঞ্চলে এখন পর্যন্ত মোট ৬টি কূপ খনন করা হয়েছে। এর মধ্যে ৫টি কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থিত। টাগবি কূপটি প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলা সীমান্তে অবস্থিত। সবগুলো কূপেই গ্যাসের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। যে কারণে বিপুল পরিমাণ গ্যাসের মজুদ আশা করা হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে এই গ্যাস স্তর সাগর এবং বিচ্ছিন্ন দ্বীপ পর্যন্ত প্রায় ২ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত।

এখান থেকে গ্যাস তুলে জাতীয় পাইপলাইনে নেওয়ার মতো অবকাঠামো নেই। যে কারণে ৬টি কূপের মধ্যে মাত্র ৪টি দিয়ে সীমিত আকার গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে। তেতুলিয়া নদীর তলদেশ দিয়ে পাইপ স্থাপন করতে হবে। অথবা নদীতে ব্রিজ নির্মাণের উদ্যোগ চলছে তার সঙ্গে যুক্ত করে বরিশাল হয়ে খুলনায় জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করা। আরেকটি বিকল্প রয়েছে এলএনজিতে রূপান্তর করে মহেষখালী এফএসআইউতে নেওয়া। এখন কাতার থেকে যে দামে এলএনজি আনা হচ্ছে ভোলা থেকে তার চেয়ে অর্ধেকের কম খরচে পাওয়া সম্ভব।

রাশিয়ান ওই কোম্পানিটিকে উচ্চমূল্যে কাজ দেওয়া নিয়ে বরাবরেই কঠোর সমালোচনা রয়েছে। রাষ্ট্রীয় কোম্পানি বাপেক্স যে কূপ ৩০ থেকে ৫৫ কোটি টাকায় খনন করতে পারে, একই কাজে তাদের দু’শ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। গ্যাজপ্রমকে এখন পর্যন্ত কয়েক ধাপে ১৭টি কূপ খননের কাজ দেওয়া। এগুলোর্ একেকটির বিপরীতে ১৪ থেকে ১৭.৫ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করা হয়। আর ভোলায় প্রস্তাবিত নতুন তিনটি কূপ খননের জন্য গ্যাজপ্রম প্রস্তাব দিয়েছে ৬৩ দশমিক ৫৮ মিলিয়ন ডলার (প্রতিটি ২১.৫ মিলিয়ন ডলার)।

ক্যাবের জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, ভোলার কূপ খননের বিষয়টি বাংলাদেশের জ্বালানি চাহিদার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। নাইকোকে যেমন বিশেষ ব্যক্তিদের লাভ-লস হিসেবে করে কাজ দেওয়া হয়েছিল, এখানে তেমনি হয়েছে। এখানে বিশেষ ক্ষমতা আইনকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ১০ টাকার কাজ একশ টাকায় দেওয়া হচ্ছে এমন অরাজকতার দৃষ্টান্ত বিশ্বের কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না।

এব্যিাপারে বাপেক্স এর এমডি মোহাম্মদ আলীকে ফোন দিলেও রিসিভ করেননি। পরে এসএমএস দিয়েও সাড়া মেলেনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *