গভীর রাতে ‘ডাকাত’ গুজবে মানুষকে আতঙ্কিত করছে কারা?

Spread the love

নাগরিক রিপোর্ট : রাত আনুমানিক দেড়টা। হঠাৎ মহল্লার মসজিদের মাইকে ঘোষনা আসে- এলাকায় ডাকাত হানা দিয়েছে। সকলে সতর্ক অবস্থায় থাকেন। একের পর এক ঘোষনা দেয়া হতে থাকে বরিশাল নগর ও সংলগ্ন ইউনিয়নের সকল পাড়া-মহল্লা, অলিগলির সকল মসজিদ থেকে। কোথায়ও কোথাও হ্যান্ডমাইকে ঘুরে ঘুরে একই ঘোষনা দেয়া হয়। মঙ্গলবার দিবাগত রাত আড়াইটা পর্যন্ত চলে এই অবস্থা। ফলে রাতটি নগরবাসীর ছিল আতংক ও ভীতিকর। নির্ঘুম রাত কাটে ঘরে ঘরে। সাহসী কিছু লোকজন ঘর থেকে বের হয়ে দলবদ্ধভাবে নিজের মহল্লায় পাহাড়া দেয়াও শুরু করে। দিনের আলো ফুটতে ঘরের বাইরে বের হওয়া লোকজন খোঁজখবর নেন- কোথায় ডাকাত হানা দিয়েছে। কিন্ত কোথাও এর অস্তিত্ব মেলেনি। দিনভর নগরে মুখে মুখে আলোচনায় ছিল- ‘রাতের ডাকাত আতংক’। পুলিশের দাবী- এটি ¯্রফে ‘গুজব’। ঝালকাঠীর নলছিটি উপজেলাতেও মঙ্গলবার মধ্যরাতে একই ঘটনা ঘটেছে বলে জানা গেছে।

কয়েকদিন যাবত চলছে বরিশালের বিভিন্ন এলাকায় গভীর রাতে মসজিদের মাইকে এলাকায় ‘ডাকাত গুজব’ ছড়ানো হচ্ছে। গত সপ্তাহে গোটা মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলায় এমন ঘটনা হয়। সোমবার মধ্যরাতে হয় বাবুগঞ্জ উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নে। সর্বশেষ ঘটল মঙ্গলবার দিবাগত মধ্যরাতে বরিশাল নগরসহ আশপাশে।

ধারাবাহিকভাবে একই ঘটনার বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ‘গুজব’ বলে হালকা করে দেয়া চেষ্টা করলেও গুজবকারী শনাক্ত করেনি। যে কারনে এর রহস্য নিয়ে সাধারন মানুষের মধ্যে চলছে নানা আলোচনা। কেউ কেউ এ ঘটনার সঙ্গে ১০ডিসেম্বর ঢাকায় বিএনপির গণসমাবেশের যোগসুত্র খুঁজছেন। বরিশালের কয়েকজন বিএনপি নেতা দাবী করেছেন, সাধারন মানুষের মধ্যে ভীতি ছড়াতে সরকার কৌশলে ডাকাত আতংক ছড়াচ্ছে। বুধবার সকালে সমকাল প্রতিবেদক নগরীর একাধিকজনের সঙ্গে কথা বললে তাদের কাছ থেকেও একই বক্তব্য আসে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ব্যক্তিরা জানান, ৩ কারনে ডাকাত গুজব ছড়ানো হতে পারে। প্রথমত, দেশে ডাকাতি বেড়ে গেছে এমন অভিযোগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সারাশী অভিযানের নামে বিএনপি নেতাকর্মীদের গণগ্রেপ্তার, দ্বিতীয়ত- বাড়িতে ডাকাতি হওয়ার ভীতিতে বিএনপির তৃনমুল নেতাকর্মীদের ঢাকায় যেতে নিরুৎসাহিত করা। আতংক ছড়িয়ে বিএনপি-জামায়াত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির চেষ্টা চালাচ্ছে- এমন মত দেন আরেকটি পক্ষ।
একাধিক মসজিদের ইমাম-মুয়াজি¥মদের সঙ্গে কথা হলে তারা রাতে মাইকিং করার কথা স্বীকার করেন। কোন তথ্যের ভিত্তিতে এলাকায় ডাকাত হানা দেয়ার খবর মাইকে প্রচার করলেন- বিষয়ে কেউ সদুত্তর দিতে পারেননি। কাশীপুর বাজার কেন্দ্রীয় মসজিদের ছানি ইমাম হাফেজ মো. নুরুন্নবী বলেন, রাত দেড়টার দিকে চারদিকের মাইকে ডাকাত হানা দেয়ার ঘোষণা দেয়া হচ্ছিল। তিনি বিষয়টি মুঠোফোনে খতিব মাওলানা জাকারিয়ার সঙ্গে জানালে তিনি জানান, ‘যেহেতু সবাই মাইকিং করছে, তুমিও করে দাও’। একই ধরনের উত্তর দেন আরও কয়েকটি মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিম।

নগরের ১২ নম্বর ওয়ার্ডের বজলু কমিশনারের বাড়ি জামে মসজিদের ইমাম মাওলানা বেল্লাল হোসেন দিয়েছেন ভিন্ন তথ্য। তিনি বলেন, ডাকাত হানা দেয়ার খবর মসজিদের মাইকে প্রচার করার জন্য রাতে তার মুঠোফোনে একটি কল আসে। তিনি প্রমান ছাড়া মাইকিং করতে অস্বীকার করেন।
২৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর জেলা আওয়ামীলীগ সদস্য শরীফ আনিসুর রহমান নিজ এলাকার ৪টি মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি। তিনি সমকালকে বলেন, তার প্রত্যেকটি মসজিদ থেকে ‘ডাকাত’ গুজব ছড়ানো হয়েছে। মাইকিং করার আগে ইমামরা তার সঙ্গে আলোচনাও করেননি। মাইকে ডাকাত আতংক ছড়াতে ইমামদের ওপর অদৃশ্য চাপ থাকতে পারে বলে দেন তিনি।

২৯ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামীলীগ সভাপতি জসিম উদ্দিন বলেন, ডাকাত আতংক ছড়ানোর পর তার পুরো পরিবার সারারাত ঘুমাতে পারেনি। তার মতে, পুরো নগরে একসঙ্গে ডাকাত হানা দিতে পারেননা। মসজিদের ইমামরা কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এ কাজটি করেছেন।

৭ নম্বর ওয়ার্ডের ভাটিখানা শরীফ বাড়ি এলাকার বাসিন্দা আবুল কালাম বলেন, যখন মাইকে প্রচার হচ্ছিল তখন তার ভবনের গেটে কয়েকটি আঘাত করে কে বা কারা একটি গাড়িতে পালিয়ে যায়। তিনি তাৎক্ষনিক কাউনিয়া থানায় জানালে পুলিশ উল্টো তার কাছে গাড়ির নম্বর জানতে চায়।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বিলকিস জাহান শিরিন বলেন, ইসলামী ব্যাংকের টাকা লুট আর ডাকাত আতংক একই সুত্রে গাথা। গোটা বাংলাদেশই এখন ডাকাতের কবলে। তিনি বলেন, সরকারের পাতানো ফাদে বিএনপি পা দিবে না। পরিবহন ধর্মঘট ও গায়েবী মামলা দিয়ে বিভাগীয় গণসমাবেশে জনস্রোত থামাতে পড়েনি। এখন ডাকাত পড়ছে বলে নতুন একটা ইস্যু সৃস্টি করছে।

মহানগর আওয়ামীলীগের সহ সভাপতি আনোয়ার হোসাইন বলেন, ব্যাংক দেউলিয়া হচ্ছে বলে যারা গুজব ছড়াচ্ছে তারাই ডাকাত আতংক ছড়িয়ে নগরবাসীকে রাতে ঘুমাতে দেয়নি। বিএনপি নগরবাসীকে রাস্তায় বের করে বিশৃঙ্খলা করতে চেয়েছিল। কারা মাইকিং করালো তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। তিনি বলেন, ১০ ডিসেম্বর যারা ঢাকায় যেতে চান তাদের সহযোগীতা করবে নগর আওয়ামীলীগ।

বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ কমিশনার (সদর) মোহাম্মদ নজরুল হোসেন বলেন, ধারনা করা হচ্ছে পরিকল্পিতকভাবে নগরে ডাকাত আতংক সৃস্টি করা হয়েছে। গুজবের উৎস্য নগরের বাইরে থেকে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ওপর মানুষের আস্থা বেশি বেশী থাকায় গুজব ছড়াতে মসজিদের মাইক ব্যবহার করা হচ্ছে। যারা করছে তাদের উদ্দেশ্যে অসৎ। গুজব সৃষ্টিকারীদের শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে কিনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন- ¯্রফে গুজব হওয়াতেই পুলিশ এনিয়ে কোন পদক্ষেপ নেয়নি। তিনি দাবী করেন, এ ঘটনার সঙ্গে ১০ ডিসেম্বর ঢাকা বিএনপির সমাবেশের কোন যোগসুত্র নেই।

একই দাবী করেন জেলা পুলিশ সুপার বলেন ওয়াহিদুল ইসলাম বলেন, শীত মৌসুমে ডাকাতের উপদ্রব বৃদ্ধি পায়। গত শনিবার দিবাগত মধ্যরাতে বাবুগঞ্জ উপজেলায় বিয়ে বাড়িতে বোমা ফাটিয়ে ডাকাতি হয়েছে। তাই গত সেখানে ডাকাত আতংক মাইকে প্রচার হয়েছে। মেহেন্দীগঞ্জে মাইকিং হয়নি বলে দাবী করেন তিনি।##

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *