সবকিছু করার জন্য তোকে কিনে এনেছি

Spread the love

‘প্রতি রাতেই শরীরের ওপর চলত নির্যাতন। প্রতিবাদ করলেই মারধর। একপর্যায়ে অজ্ঞান হয়ে পড়তাম। কিন্তু তাতে তারা থেমে যেত না। ওই অবস্থায়ই শরীরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত। জ্ঞান ফিরলে বুঝতে পারতাম সেটা।’

গত ২৬ আগস্ট সৌদি আরব থেকে দেশে ফেরা এক নারী এভাবে নির্যাতনের বর্ণনা দেন। সেদিন তার সঙ্গে আরও ১১১ নারী দেশে ফেরেন। তাদের সাক্ষাৎকার নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়।

পরে সেই প্রতিবেদন সংসদীয় কমিটিতে উপস্থাপন করা হয়। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে ফেরা ১১১ নারীর মধ্যে ৩৮ জন যৌন নির্যাতনের কারণে দেশে ফিরতে বাধ্য হন। এছাড়া ৪৮ জন নিয়মিত বেতন-ভাতা না দেয়ায়, পর্যাপ্ত খাবার খেতে না দেয়ায় ২৩ জন, চারজন ছুটি না দেয়ায়, মালিক ছাড়া অন্য বাড়িতে কাজ করানোর জন্য সাতজন, ১০ জন অসুস্থতার কারণে, পারিবারিক কারণে একজন, ভিসার মেয়াদ না থাকায় আটজন, দুই বছরের চুক্তি শেষ হওয়ায় ১৬ জন এবং অন্যান্য কারণে দুজন ফিরে আসেন।

যৌন নির্যাতনের শিকার এসব নারীর কথায় ফুটে উঠেছে নির্মম প্রহরের বর্ণনা। তারা বলছেন, সুস্থ মানুষ হিসেবে সৌদি যাওয়ার পর মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে অসুস্থ হয়ে ফিরতে হয়েছে।

শুরুতে ওই নারী বলেন, রিক্রুটিং এজেন্সি আমাকে ৪০ হাজার টাকার বিনিময়ে সৌদি আরবে পাঠায়। প্রথম এক বছর দেড় মাস একটি বাসায় কাজ করি। তারা নিজেদের বাসা ছাড়া আত্মীয়দের বাসায় নিয়েও কাজ করাত। অথচ তিনবেলা ঠিক মতো খেতেই দিত না। এমনকি এত কাজ করার পরও বেতন পেতাম না। দেশে থাকতে আমাকে দালালরা বলেছিল ২০ হাজার টাকা বেতন দেবে।’

‘কাজ করতে গিয়ে কেন আমাকে নির্মম নির্যাতনের শিকার হতে হলো’- প্রশ্ন করেন ওই নারী।

তিনি বলেন, ‘আমার কাছে মোবাইল দিত না। শুধু বলত, বেতন পাঠিয়েছি। তারপর আমার কাছ থেকে একটা কাগজে স্বাক্ষর নিত। তবে শেষ দিকে আমি যখন প্রতিবাদ করলাম, নিজে অসুস্থ হওয়ায় অন্য বাসায় কাজ করতে যেতে চাইতাম না। হঠাৎ একদিন আমাকে জোর করে অন্য একটি বাসায় পাঠানো হলো।’

‘নতুন বাসায় গিয়ে আমি পড়লাম আরেক বিপদে। সেখানে আমাকে শারীরিক নির্যাতন করত। নতুন মালিক বলল, বাংলাদেশি প্রায় চার লাখ টাকায় তার কাছে আমাকে বিক্রি করেছে।’

‘ওই মালিক বলেন, তোকে কিনে এনেছি। তোর সঙ্গে যা ইচ্ছা তা-ই করব। এভাবে প্রতি রাতে আমার ওপর যৌন নির্যাতন করা হতো। কিন্তু একদিন আমি পালিয়ে সৌদি পুলিশের কাছে ধরা দেই। আমার কাছে কোনো কাগজপত্র না থাকায় সৌদি পুলিশ আমাকে জেলে পাঠায়।’

এদিকে মা আমার খোঁজখবর না পেয়ে দালালের শরণাপন্ন হন। তিনি দালালকে অনুরোধ করেন আমাকে ফেরত আনার। কিন্তু তারা উল্টো মাকে ভয়ভীতি দেখায়। পরে দালালকে ৬০ হাজার টাকা দিলে তারা আমাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে রাজি হয়।

তবে তারা আমাকে ফেরত আনেনি। প্রায় দেড় মাস জেল খাটার পরে তারা আমাকে সৌদিতে বাংলাদেশ দূতাবাসে পাঠায়। দূতাবাস আমাকে আরও অনেক নারীর সঙ্গে দেশে পাঠায়।

তিনি বলেন, সৌদি মালিকের নানা নির্যাতনে আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছি। দেশে ফেরার পরে চিকিৎসা নিচ্ছি।

ওই নারীর মা সাহিদা বেগম বলেন, ‘আট বছরের একমাত্র মেয়ের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে টাকা আয় করতে সৌদি যায় মেয়ে। তার স্বামী থাকলেও বউ-সন্তানের খোঁজ নেয় না। টাকা তো আয় হয়নি বরং উল্টো মেয়ে অসুস্থ হয়ে ফিরেছে।‘

বাংলাদেশ নারী শ্রমিক কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম বলেন, আমাদের নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেই বিদেশে পাঠাতে হবে। পাশাপাশি বিদেশ পাঠানোর আগে ভাষা ও কাজে দক্ষকর্মী হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।

প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন গণমাধ্যমেকে বলেন, ‘নানা নির্যাতনের শিকার হয়ে সৌদি আরব থেকে নারী শ্রমিকদের ফিরে আসা সম্পর্কে সরকার অবগত। এ বিষয়ে প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রীর সর্বশেষ সফরেও দেশটির কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *