অনলাইনে পশু ক্রয়-বিক্রয় ইসলামের বিধান

Spread the love

পবিত্র ঈদুল আজহা সন্নিকটে। চারদিকে বিরাজ করে উৎসবের আমেজ। কিন্তু কভিড-১৯ মহামারি ও চলমান বন্যা পরিস্থিতির প্রভাবে এ বছরের চিত্র আগের চেয়ে ভিন্ন। মানুষের নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে অনলাইনেই শুরু হয়েছে পশুর হাট। যেকোনো ক্রেতা পশু কিনতে পারবে ঘরে বসেই। স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়াতে অনেকেই এবার অনলাইনে পশু কেনার কথা ভাবছে। এসবের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ইসলামের বিধান। এখানে সেসব বিষয়ে আলোচনা করা হলো—

অনলাইনে পশু ক্রয়

ইসলামী নিয়ম মেনে অনলাইনে পশু ক্রয়ে ইসলামে বাধা নেই। তবে এ ক্ষেত্রে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয় পক্ষকে কিছু বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। প্রথমত, বিক্রেতা ওয়েবসাইট থেকে বিক্রীত পশুটি মালিককে হস্তান্তরের সময় পশুর মালিক হতে হবে। যেমন—সরকারি উদ্যোগে পরিচালিত ডিজিটাল হাট ব্যবহার করে যে কেউ তাদের গরু সরাসরি বিক্রি করতে পারে। আবার ‘দেশি গরু ডটকম’, ‘বেঙ্গল মিট’সহ কিছু অনলাইন পশুর হাট তাদের নিজস্ব খামারের গরু অনলাইনে বিক্রয় করছে। ফলে এখানে অনলাইনে বেচাকেনা করলেও উল্লিখিত শর্ত পালন হচ্ছে। কিছু কম্পানি সরাসরি খামারির বাড়ি গিয়ে গরুর স্বাস্থ্য, বয়স ইত্যাদি বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে পরীক্ষা করে গরুর থ্রি সিকটি ডিগ্রি ছবি, ভিডিও, গরুর উচ্চতা, দাঁতের সংখ্যাসহ বিস্তারিত তথ্য তাদের সাইটে আপলোড করছে। যখন ক্রেতা সেখান থেকে কোনো পশু পছন্দ করে, তখন অনলাইন শপ খামারির কাছ থেকে ক্রেতার পছন্দের পশুটি কিনে নিয়ে ক্রেতার বাড়ি পৌঁছে দেয়। অনলাইন শপ ও পশু ক্রেতার মধ্যকার মূল বেচাকেনা তখনই হয়। ফলে এখানে উল্লিখিত শর্ত পালন হয়ে যায়। দ্বিতীয় শর্ত হলো, ক্রয়-বিক্রয়ে ইজাব কবুল থাকতে হবে। অর্থাৎ অনলাইন শপে কোনো পশু পছন্দ হলে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে কথা বলে পশুর ক্রয়-বিক্রয় করতে হবে। তৃতীয়ত স্বচক্ষে দেখার পর যদি পশুর মধ্যে দোষত্রুটি পাওয়া যায়, তাহলে অবশ্যই টাকা ফেরত দিতে হবে। এ ব্যাপারে দারাজের কমার্শিয়াল অ্যাকুইজিশন ম্যানেজার সাইমুন সানজিদ চৌধুরী বলেন, ‘আমরা সাধারণত এমন কোনো পশু ওয়েবসাইটে আপলোড করি না যেগুলোর মধ্যে কোনো ত্রুটি আছে। আমাদের টিম প্রতিটি পশুকে ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করে সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত আছে কি না, তা আগে থেকেই নিশ্চিত হয়ে নেয়। এর পরও যদি ডেলিভারি দেওয়ার পর তাতে কম্পানির পক্ষ থেকে কোনো ত্রুটি পাওয়া যায়, তাহলে কম্পানি ক্রেতার টাকা ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা করবে।’

ইএমআই বা কিস্তিতে কোরবানির পশু ক্রয়

ইএমআই পদ্ধতি বা কিস্তিতে কোরবানির পশু কেনা জায়েজ হওয়ার জন্য শর্ত হলো, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে যদি ক্রেতা পশুর মূল্য পরিশোধ না করতে পারে, তাহলে পরে তার থেকে কোনো বাড়তি টাকা উসুল করা যাবে না। পশু বেচাকেনার সময় যে মূল্য নির্ধারণ হবে, ক্রেতা তাদের সেই মূল্যই পরিশোধ করবে। (ফাতাওয়ায়ে ফকীহুল মিল্লাত : ৯/৪৪৭)

অনলাইন পেমেন্ট

মোবাইল ব্যাংকিং : অনলাইনে কেনাবেচা করার একটি সহজ মাধ্যম হলো মোবাইল ব্যাংকিং। বর্তমানে মানুষের কাছে এটিই লেনদেনের সবচেয়ে সহজ মাধ্যম। যেহেতু এখানে মোবাইল ব্যাংকিং কম্পানিকে নির্দিষ্ট পরিমাণ সার্ভিস চার্জ দিয়ে তাদের সেবা নেওয়া হয়, সেহেতু সাধারণত এটি ব্যবহার করে কেনাবেচা করার মধ্যে ইসলামের নিষেধাজ্ঞা নেই। কিন্তু কিছু কিছু মোবাইল ব্যাংকিং সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান তাদের অ্যাকাউন্টে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা জমা রাখলে এর বিনিময়ে সুদ প্রদান করে। যদি কারো মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্টে এ রকম সুদের টাকাও থাকে, তাহলে সেই টাকা দিয়ে কোরবানির পশুর মূল্য পরিশোধ করা জায়েজ হবে না।

ডেবিট কার্ড : ডেবিট কার্ডের মাধ্যমেও কোরবানির পশুর মূল্য পরিশোধ করা জায়েজ। যেহেতু এর মাধ্যমে ক্রেতা তার নিজের অ্যাকাউন্টে বিদ্যমান টাকাই খরচ করতে পারে। তবে এই লেনদেন শতভাগ বিশুদ্ধ হওয়ার জন্য শরিয়া মোতাবেক পরিচালিত ব্যাংকগুলোর ডেবিট কার্ড ব্যবহার করা উত্তম। কারো যদি সুদি ব্যাংকের কার্ড ব্যবহার করেই কিনতে হয়, তাহলে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে যাতে সেখানে কোনো সুদের টাকা মিশ্রিত না হয়ে যায়।

ক্রেডিট কার্ড : প্রথমত একান্ত প্রয়োজন ছাড়া বিকল্প ব্যবস্থা থাকা অবস্থায় সুদি ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড গ্রহণ করা জায়েজ নেই। তাই কেউ যদি বিকল্প ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও এ ধরনের ক্রেডিক কার্ড ব্যবহার করে সে গুনাহগার হবে। দ্বিতীয়ত ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে কোরবানির গরুর মূল্য পরিশোধ করার অর্থ হলো, সুদে ঋণ নিয়ে সেই টাকায় কোরবানি করা। সুদের শর্তে ঋণ নেওয়া ইসলামের দৃষ্টিতে স্পষ্ট হারাম। কিন্তু টাকাগুলো হারাম নয়। (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৭৫-২৭৯, ফাতাওয়ায়ে ফকীহুল মিল্লাত : ১০/১০০)

অতএব সুদি ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে যদি কোরবানির পশু ক্রয় করে, সে গুনাহগার হবে। এ ধরনের ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে কোরবানির পশু কেনা উচিত নয়। কিন্তু কেউ কিনে ফেললে তার কোরবানি হয়ে যাবে।

মেশিনে কোরবানির পশু জবাই

এ বছর কোরবানি করে কোরবানির পশুর গোশতগুলো প্যাকেট করে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার অফার দিয়েছে কিছু প্রতিষ্ঠান। হয়তো এই প্রতিষ্ঠানগুলোও বিশ্বের বড় বড় প্রতিষ্ঠানের মতো মেশিনে পশু জবাই থেকে শুরু করে সব কার্যক্রম সম্পন্ন করতে পারে। তাই মেশিনে কোরবানি করার ইসলামী পদ্ধতিও জেনে রাখা উচিত।

ইন্টারনেটে দেখা যায়, কিছু মেশিন আছে এমন সেখানে একবার মেশিন চালু করে দিলে অটোমেটিক অনেক পশুকে একসঙ্গে জবাই করে ফেলে। এ ধরনের মেশিনে পশু কোরবানি করলেও প্রতিটি পশু জবাইয়ের সময় আলাদা আলাদা ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ পড়ে মেশিনের সুইচ চাপতে হবে। নইলে কোরবানি হবে না। এমন পশুর গোশত খাওয়াও জায়েজ হবে না। (ফাতাওয়ায়ে উসমানি : ৪/৩৬)

বাংলাদেশের মিট প্রসেসিং কম্পানিগুলো কী পদ্ধতিতে পশু জবাই করে, এ ব্যাপারে বেঙ্গল মিটের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা জানায়, শতভাগ ইসলামী রীতি অনুসরণের জন্য তারা কোরবানির পশুগুলোকে মেশিনে জবাই করে না। বরং পশুগুলোকে ইসলামী পদ্ধতিতে ম্যানুয়ালি জবাই করে পরে গোশতগুলো মেশিনে প্রসেস করা হয়। সরকারি উদ্যোগে পরিচালিত ডিজিটাল হাটের ভাষ্যমতে তারা অভিজ্ঞ মৌলভি সাহেবদের দিয়ে কোরবানি করিয়ে অভিজ্ঞ কসাইয়ের মাধ্যমে গোশত প্রসেস করে মানুষের ঘরে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা রেখেছে।

মহান আল্লাহ সবাইকে সঠিক পদ্ধতিতে কোরবানি করার তাওফিক দান করুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *