বরিশালে গুরুত্ব বেড়েছে প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক এমপি’র, চাপে মেয়র সাদিক

Spread the love

নাগরিক রিপোর্ট : বরিশালে মেয়র-ইউএনও কান্ডের পর স্থানীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ন হয়ে উঠেছেন জেলা আওয়ামীলীগের সহ সভাপতি ও বরিশাল- ৫ (মহানগর-সদর) আসনের সংসদ সদস্য প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামীম। ক্রমশ বাড়ছে তার অনুসারীদের বলয়। সর্বশেষ রোববার বিকালে বরিশাল সিটি করপোরেশনের ৯ কাউন্সিলর ঢাকায় সাক্ষাত করেছেন প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে। কাউন্সিলরদের মধ্যে ৫ জন গত আগষ্টে প্রথম সপ্তাহ থেকে প্রতিমন্ত্রীর বলয়ে যুক্ত হন। নতুন করে তাদের সঙ্গে একাট্রা হয়েছেন আরও ৪ জন। প্রতিমন্ত্রীর বলয়ে আরও অর্ধডজন কাউন্সিলর যুক্ত হবেন- এমন খবর মিলছে সংশ্লিষ্ট সুত্রগুলো থেকে। গত ২৯ আগষ্ট জেলা আওয়ামীলীগের এক গুরুত্বপূর্ন সহ সভাপতিও হঠাৎ করে ওঠেন প্রতিমন্ত্রীর মঞ্চে। সবমিলিয়ে মেয়র-ইউএনও কান্ডের পর কিছুটা নিস্প্রভ হয়ে থাকা বরিশাল আওয়ামীলীগের ঘরোয়া রাজনীতি ক্রমশ সরগরম হয়ে উঠছে।
জেলা আওয়ামীলীগের সহ সভাপতি প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামীম বরিশাল মহানগর ও সদর উপজেলা নিয়ে গঠিত বরিশাল- ৫ আসনের এমপি হলেও তার রাজনৈতিক পদচারনা শুরু থেকেই নিরবে-নিভৃতে। তবে নগরের রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করে একক নিয়ন্ত্রকের আসনে আছেন মহানগর আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ। ২০১৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর থেকে জেলা ও মহানগর আওয়ামীলীগের শীর্ষ নেতারা এবং স্থানীয় জনপ্রতিধিরা অদৃশ্য কারনে প্রতিমন্ত্রীর কাছে যেতেন না।
তবে গত ১৮ আগষ্ট রাতে সদর উপজেলা পরিষদ চত্বরে সিটি করপোরেশনের কর্মী পরিচয়ে প্রতিমন্ত্রীর ব্যানার ফেষ্টুন অপসারন করতে গেলে ইউএনও’র বাসভবনে হামলা, আনসারদের গুলিবর্ষন এবং পরবর্তীতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে মেয়র অনুসারী নেতাকর্মীদের ব্যাপক সংঘর্ষের পর বড় ধরনের হোচট খায় স্থানীয় আওয়ামীলীগের রাজনীতি। ইউএনও-পুলিশের মামলায় মেয়রসহ তার অনুসারীরা আসামী হয়ে এখনও অনেকটা কোনঠাসা হয়ে আছেন। এ প্রেক্ষাপটে রোববার বিকালে ৯ কাউন্সিলর ঢাকায় গিয়ে সংসদ ভবনে প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুকের সঙ্গে সাক্ষাত করেন। প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে কাউন্সিলরদের একাধিক ছবি সোমবার রাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ পেলে নতুন করে আলোচনায় এসেছে এখানকার আওয়ামীলীগের রাজনীতি।
প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাত করতে যাওয়া একাধিক কাউন্সিলর সমকালকে বলেছেন, মেয়র সাদিক আবদুল্লাহর অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা থাকায় তারা প্রতিমন্ত্রীকে এড়িয়ে চলতেন। তিন বছর ধরে মেয়রের কাছ থেকে পাওয়া অবহেলা ও অপমানে ক্ষুদ্ধ কাউন্সিলরা তাই প্রতিমন্ত্রীর বলয়ে ভিড়েছেন। আরও অর্ধডজন কাউন্সিলর শিগগিরিই প্রতিমন্ত্রীর বলয়ে যুক্ত হবেন বলে এসব কাউন্সিলরা জানান।
প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতে অংশ নেয়া কাউন্সিলররা হলেন- ১ নম্বর ওয়ার্ডের আমীর বিশ্বাস, ৪ নম্বর ওয়ার্ডের তৌহিদুল ইসলাম বাদশা, ১২ নম্বর ওয়ার্ডের জাকির হোসেন ভুলু, ২০ নম্বর ওয়ার্ডের জিয়াউর রহমান বিপ্লব, ২২ নম্বর ওয়ার্ডের আনিসুর রহমান দুলাল, ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের এনামুল হক বাহার, ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের শরীফ মো. আনিসুর রহমান, ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের হুমায়ন কবির এবং ২৯ নম্বর ওয়ার্ডের ফরিদ আহম্মেদ।
প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে কি আলোচনা হয়েছে জানতে চাইলে একাধিক কাউন্সিলর বলেন- রোববার বিকাল ৪টা থেকে দেড়ঘন্টা তারা জাতীয় সংসদ ভবনে প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামীমের দপ্তরে তার সঙ্গে একান্তে আলোচনা করেছেন। সে আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল স্থানীয় রাজনীতি ও উন্নয়ন। প্রতিমন্ত্রী মহানগরে সুস্থ্য রাজনৈতিক চর্চার মাধ্যমে দলকে শক্তিশালী করাসহ নগর ও সদর আসনের উন্নয়নে কাউন্সিলদের পাশে থাকবেন বলে আশ্বস্ত করেছেন। আধিপত্যের মানসিকতা পরিহার করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়নের বার্তা নগরবাসীর কাছে পৌছে দেয়ার জন্য কাউন্সিলদের পরমর্শ দিয়েছেন প্রতিমন্ত্রী।
জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি (জাতীয় ছাত্রলীগ) ২২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আনিছুর রহমান দুলাল প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাত প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমরা মেয়র সাদিক আবদুল্লাহর অসহযোগীতা ও স্বেচ্ছাচারিতার শিকার। বরিশালে যে গুমোট রাজনৈতিক অবস্থা বিরাজ করছিল সে অবস্থার পরিবর্তন করা যায় কি-না তার জন্য জেলা আওয়ামীলীগের সহ সভাপতি ও প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামীম এমপির সঙ্গে সাংগঠনিক এবং উন্নয়ন কার্যক্রম নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেছি। প্রতিমন্ত্রী আমাদের বলেছেন, সংগঠন গোছাতে। কারো সঙ্গে কোন সংঘাতে আমরা যাবনা। দুলাল বলেন, বিএনপির লোকজন নিয়ে মহানগর আওয়ামীলীগের কমিটি হয়েছে। অথচ আমরা দলে ভাল জায়গা পাইনা। মেয়র সাদিক নগর পরিষদের সভা করেন বাসায়। সেখানে কাউন্সিলদের সঙ্গে দূর্ব্যবহার করেন। আমরা এসব স্বেচ্ছাচারিতার পরিবর্তন চাই’।
২৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর শরীফ আনিছুর রহমান বলেন, আমরা কারও বিরুদ্ধে যাইনি। দলের স্বার্থে প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাত করেছি। যেখানে সম্মান পাওয়া যায়না, পদে পদে হেনস্থা হতে হয় সেই বলয়ে থেকে লাভ কি?। শুধু আমরাই নই আরও প্রায় অর্ধডজন কাউন্সিলর যোগ দিবেন প্রতিমন্ত্রীর বলয়ে। আমরা বরিশাল নগর এবং সদর আসনে সুস্থ্য রাজনীতির ধারা সৃষ্টি করতে চাই।
২৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর এনামুল হক বাহার বলেন, বরিশাল মহানগর আওয়ামীলীগে নেতাকর্মীদের সম্মান নেই। গত তিনবছরে আমরা দলীয়ভাবে মযাদা পাইনি। প্রতিমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন তিনি সুস্থ্য ও জনমুখী রাজনৈতিক কার্যক্রমে সহযোগিতা করবেন। আমাদের মতো প্রতিমন্ত্রীও চান নগর আওয়ামীলীগ শক্তিশালী হোক।
১২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো: জাকির হোসেন ভুলু বলেন, জাহিদ ফারুক স্থানীয় সাংসদ। আমরা একই দল করি। প্রতিমন্ত্রীর কাছে যাওয়া কোন অপরাধ নয়।
প্রসঙ্গত, গত ১৮ আগষ্ট রাতে তুলাকালাম কান্ডের পর এ ঘটনায় ইউএনও এবং পুলিশ বাদী হয়ে মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহকে প্রধান আসামী করে পৃথক দুটি মামলা দায়ের করেন। ইউএনও মো. মুনিবুর রহমান এবং কোতোয়ালী মডেল থানার ওসিকে আসামী করেও পাল্টা দুটি মামলাও হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে প্রশাসনের উর্ধ্বতন মহলের হস্তক্ষেপে গত ২২ আগষ্ট রাতে বরিশাল বিভাগীয় কমিশনার মো. সাইফুল হাসান বাদলের সরকারি বাসভবনে দুপক্ষের মধ্যে সমঝোতায় পরিস্থিতি শান্ত হয়। পর্যাক্রমে আদালত থেকে জামিনে মুক্ত হয়েছেন গ্রেফতার হওয়া নগর আওয়ামীলীগের ২১ নেতাকর্মী। পরিস্থিতি দৃশ্যমান শান্ত হলেও প্রশাসনের সঙ্গে মেয়র সাদিক আবদুল্লাহর সৃষ্ঠ দুরত্বে নগর আওয়ামীলীগের রাজনীতিতে পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে। মেয়র সাদিক আবদুল্লাহ গত ২৭ আগষ্ট থেকে ঢাকায় অবস্থান করছেন। তার অনুসারী নেতাকর্মীরাও চুপচাপ।
অপরদিকে ঘটনার সময় ঢাকায় থাকলেও পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী কর্ণেল (অব:) জাহিদ ফারুক এমপি ২৮ আগষ্ট থেকে ৩দিন বরিশাল সফর করেন। একাধিক কর্মসূচীতে অংশগ্রহন করলেও ১৮ আগষ্ট রাতের ঘটনা নিয়ে কোন মন্তব্য করেননি। অপরদিকে জেলা ও মহানগরের শীর্ষ নেতারা আগের মতোই প্রতিমন্ত্রীর কর্মসূচীতে যাননি।
তবে ২৯ আগষ্ট রোববার চরমোনাই ইউনিয়নে প্রতিমন্ত্রীর উদ্যেগে সেলাই মেশিন বিতরণ অনুষ্ঠানে অংশনিয়ে বক্তৃতায় জেলা আওয়ামীলীগের সহ সভাপতি সৈয়দ আনিসুর রহসান বলেন, বরিশালের রাজনীতি সন্ত্রাস নির্ভর হওয়ায় তিনি স্বেচ্ছায় রাজনীতি থেকে দুরে আছেন। প্রতিমন্ত্রীর শান্তিপূর্ন কর্মকান্ডের সঙ্গে থেকে তিনি আবারও রাজনীতিতে সক্রিয় হতে চান।
স্থানীয় সাংসদ প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে দুরত্ব প্রসঙ্গ জানতে চাইলে জেলা আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক তালুকদার মো. ইউনুস বলেন, ‘প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামীমের সঙ্গে আমাদের কোন বিরোধ নেই। তিনি রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যস্ত থাকায় স্থানীয় আওয়ামীলীগের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহন করতে পারেন না’।
রোববার ৯ কাউন্সিলের সঙ্গে সাক্ষাত প্রসঙ্গে প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামীম এমপি বলেন, কাউন্সিলদের সঙ্গে সাধারন আলোচনা হয়েছে। কাউন্সিলরা তাদের সুবিধা-অসুবিধবার কথা আমাকে বলেছেন। নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে তারা অবহেলিত। ভোটারদের কাছে মুখ দেখাতে পারেননা। আমি তাদেরও জনপ্রতিনিধি। তারাও আমার ভোটার। তাদের কথা শুনেছি এবং দল ও উন্নয়নের স্বার্থে পাশে থাকার কথা বলেছি।
মেয়র অনুসারী মহানগর আওয়ামীলীগের সহ সভাপতি ও সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র গাজী নঈমুল ইসলাম লিটু প্রতিমন্ত্রীরদের সঙ্গে কাউন্সিলদের সাক্ষাত প্রসঙ্গে বলেন, যারা প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাত করেছেন তারা দলের পুরানো কর্মী। যার সঙ্গে সাক্ষাত করেছেন তিনি জেলা আওয়ামীলীগের সহ সভাপতি। এতে দোষের কিছু নেই, স্বাভাবিক ঘটনা। মহানগরও প্রতিমন্ত্রীর নির্বাচনী এলাকা। দলের যে কেউ তার কাছে যেতে পারেন।
মেয়রের বিরুদ্ধে কাউন্সিলদের যত অভিযোগ : ক্ষুদ্ধ কাউন্সিলণদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে সিটি করপোরেশনের নিয়মানুযায়ী কাউন্সিলদের নিয়ে পৃথক ১৪টি স্থায়ী কমিটি গঠনের নিয়ম রয়েছে। গত তিনবছরে একটি কমিটিও গঠন করেননি মেয়র সাদিক। তিনি পরিষদের সভা ডাকেন বাসায়। সেখানে মেয়রের অনুসারী ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের সভাপতি-সাধারন সম্পাদকদের রাখা হয়। তাদের সামনেই তিনি কাউন্সিলরদের অপমান করেন। কোন ওয়ার্ড পরিদর্শনে গেলে কাউন্সিলদের জানানো হয়না। ওয়ার্ড সভাপতি-সাধারন সম্পাদক থাকেন মেয়রের সঙ্গে। করোনাকালীন সময়ে দুস্থ্যদের মধ্যে খাদ্য সহায়তা কাউন্সিলদের না দিয়ে ওয়ার্ড সভাপতি-সাধারন সম্পাদকদের মাধ্যমে বিতরণ করা হয়েছে। মেয়র তার অনুসারী ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতাকর্মীদের সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন পদে অস্থায়ী নিয়োগ দিয়েছেন। তাদেরকে নানা অনৈতিক কর্মকান্ডে ব্যবহার করা হয়। এক কাউন্সিলর বলেন, গত তিন বছরে মেয়র তাকে একটি বারও ফোন দেননি। তিনিও কাউন্সিলদের ফোন ধরেন না। দীর্ঘদিনের ক্ষোভে গত আগষ্টের প্রথম সপ্তাহে ৬ কাউন্সিলর মেয়রের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে প্রতিমন্ত্রীর দেয়া খাদ্য সহায়তা স্থানীয়দের মধ্যে বিতরণ করে আলোচনায় আসেন। এরই ধারাবাহিকতায় রোববার যুক্ত হলেন আরও ৩ কাউন্সিলর।##

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *