‘সুষ্ঠু অইলে ভোট দেতে যামু, আগের মতো অইলে মোরা ভোটে নাই’।

Spread the love

নাগরিক রিপোর্ট : দক্ষিণাঞ্চলে প্রবেশপথ বরিশাল নগরী থেকে ১০ কিলোমিটার দুরে বরিশাল-ঢাকা মহাসড়ক সংলগ্ন রহমতপুর বাজার। ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনের দারুন আমেজ বিরাজ করছে সেখানে। আগামী ২৮ নভেম্বর তৃতীয় ধাপ নির্বাচনে রহমতপুর ইউনিয়নে ভোট অনুষ্ঠিত হবে। ভোট সুষ্ঠু হলে স্বতস্ফুর্তভাবে কেন্দ্রে গিয়ে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেবেন, এমন ভাবনায় ভোটাররা উৎফুল্ল। এর আগে দুটি ধাপে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সংলগ্ন সদর উপজেলার ১০টিসহ আরও কয়েকটি ইউপিতে ভোটের শেষ সময় পর্যন্ত ছিল উৎসবমুখর পরিবেশ। রহমতপুরের ভোটাররাও এমন পরিবেশের আশায় আছেন। আবার ঠিক বিপরীত চিত্র বিরাজ করছে দক্ষিণের শেষপ্রান্ত বঙ্গোপসাগর তীরের জনপদ বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলায়। সেখানে প্রতীক পাওয়ার পর থেকেই নৌকার ছাড়া অপর প্রতীকের প্রার্থীরা মাঠে নামতে পারছেন না। একই সংসদীয় আসনভুক্ত পাশের উপজেলা বেতাগীতে দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে ব্যাপক নৈরাজ্য হওয়ায় পাথরঘাটাতেও এর প্রভাব পড়েছে বলে ভোটারদের অভিযোগ। অজানা আতংকে আছেন ভোটাররা। তাদের সাফ কথা ‘সুষ্ঠু অইলে ভোট দেতে যামু, আগের মতো অইলে মোরা ভোটে নাই’।
আগামীর ২৮ নভেম্বর বরিশাল বিভাগে ২৪টি ইউপিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। বেশীরভাগ ইউপির অবস্থা পাথরঘাটা উপজেলার মতো বলে স্থানীয় সুত্রগুলো জানিয়েছেন।
এর আগে গত ২১ জুন ও ১১ নভেম্বর বরিশাল বিভাগে মোট ৯৮টি ইউপিতে নির্বাচন সম্পন্ন হয়। বিএনপিবিহীন নির্বাচনে নৌকার জয়-জয়কার হলেও ভোটাধিকার কেড়ে নেয়া এবং সন্ত্রাস ও লাশ পড়ার দায় এড়তে পারেননি তারা। দুটি ধাপের নির্বাচনে বিভাগে এ পর্যন্ত প্রাণ গেছে ৭ জনের।
বরিশালের উজিরপুর উপজেলার গুঠিয়া ইউনিয়নে হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত হওয়ার তথ্য গোপন করায় প্রার্থীতা হারিয়েছেন নৌকার প্রাথী আব্দুস সাত্তার মোল্লা। নৌকাবিহীন নির্বাচনেও এ ইউনিয়নে উত্তাপের কমতি নেই। সোমবার দুপুরে সন্ধ্যা নদীর তীরে দাশেরহাট বাজারের একটি চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন গ্রামের ৮-১০ জন মানুষ। আলোচনার বিষয়বস্তুু যথারীতি ভোট। তাদের আলোচনায় কানপেতে বোঝা গেল- চেয়ারম্যান কে হবেন তার চেয়েও বড় বিষয় তারা কেন্দ্রে গিয়ে স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারবেন কি-না। হাসান নামক মধ্যবয়স্ক এক ভোটারের কাছে গুঠিয়ার ভোটের পরিস্থিতি জানতে চাইলে বলেন, এখানে নৌকার প্রার্থী নেই। স্বতন্ত্র প্রার্থী আওয়ামীলীগ নেতা আওরঙ্গজেব (মোটরসাইকেল) ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতা সজিব সরদারের (আনারস) মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে।
স্থানীয়রা জানান, দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে আওরঙ্গজেব জেলা পরিষদের সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। নৌকার প্রার্থীতা বাতিল হওয়ায় স্থানীয় আওয়ামীলীগ ভাগ হয়ে গেছেন স্বতন্ত্র দুই প্রার্থীর পক্ষে।
সজিব সরদার মঙ্গলবার আইনশৃঙ্খল বিষয়ক সভায় প্রতিদ্বন্দ্বি আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট ৫টি অভিযোগ তুলেছেন। অভিযোগগুলো হচ্ছে- প্রতিটি সভায় মসজিদ-মন্দিরে অনুদান প্রদান, মসজিদের ভেতরে প্রচারনা চালানো, গাড়িতে সাইরেন বাজিয়ে এলাকায় আতংক সৃষ্টি, টাকা দিয়ে ভোটারদের প্রভাবিত করা এবং ইউনিয়নে সরকারি উন্নয়ন কাজগুলো আওরঙ্গজেব জেলা পরিষদ সদস্য হিসাবে করেছেন বলে প্রচার চালাচ্ছেন বর্তমান চেয়ারম্যান ডা. দেলোয়ার হোসেন।
রহমতপুরে নৌকা প্রতীক বঞ্চিত হয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন বর্তমান চেয়ারম্যান সরোয়ার মাহমুদ। নৌকার প্রার্থী উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক মিলন মৃধা, ওয়ার্কাস পার্টির শাহীন হোসেন ও স্বতন্ত্র প্রার্থী মোস্তফা কামালের সরগরম প্রচারে চতুমূর্খী প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে বলে জানান একাধিক ভোটার। তবে সুষ্ঠু ভোট নিয়ে আশংকা রয়েছে সকল ভোটারের মধ্যে। মোতালেব মিয়া নামক একজন শিক্ষক জানান, – ‘প্রশাসন যদি নিরপেক্ষ থাকে তাহলে রহমতপুরে সুষ্ঠু ভোট হবে’। উজিরপুরের বামরাইল ও হারতা ইউপিতে নির্বাচন হবে ২৮ নভেম্বর।
সাগরতীরের জনপদ বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার স্থানীয় সুত্রগুলো জানিয়েছে, প্রতীক পাওয়ার পরই সেখানকার নির্বাচনী পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। এ উপজেলার ৭টি ইউনিয়নের ৪টিতে ২৮ নভেম্বর নির্বাচন হবে। তারমধ্যে চরদোয়ানীতে নৌকার চেয়ারম্যান প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। অপর ৩টি ইউনিয়ন যথাক্রমে রায়হানপুর, নাচনপাড়া ও সদর ইউপির নৌকার প্রার্থীরা সংরক্ষিত নারী সংসদ সদস্য সুলতানা নাদিরার অনুসারী বলে স্থানীয় সুত্র নিশ্চিত করেছে। সদরে নৌকা মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন বর্তমান চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান রিপন। তিনি স্থানীয় সংসদ সদস্য শওকত হাচানুর রহমান রিমনের সমর্থক বলে জানা গেছে।
সোমবার আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায়া সদরের স্বতন্ত্র প্রার্থী বর্তমান চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান আসাদ জানান, তিনি গত ১২ নভেম্বর প্রতীক পাওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত মাঠে ভোট চাইতে নামতে পারেননি। ১৪ নভেম্বর তার কিছু প্রতিবেশী ভোটারদের নিয়ে তার বাড়ির আশেপাশে প্রচারে বহিরাগত সস্ত্রাসীরা চারদিক দিয়ে ঘিরে রাখে। পরে পুলিশ গিয়ে তাকে উদ্ধার করে বাসায় পৌছে দেয়। একই ইউনিয়নে পাথরঘাটা উপজেলা বিএনপির সভাপতি এম মতিউর রহমান মোল্লা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। তিনিও একই অভিযোগ করেন আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায়। অপরদিকে নাচনপাড়া ইউপিতে নৌকার বর্তমান চেয়ারম্যান ফরিদ মিয়া অভিযোগ করেন, তার ইউনিয়নে মারজান নামের এক সন্ত্রাসী ও মাদক ব্যাবসায়ী চাঁদা চেয়ে তাকে হুমকি দমকি দিচ্ছে। তাদের টাকা না দেয়ায় তার লোকজন ও কর্মী ভাইদের মারধর করা হচ্ছে। এরা আওয়ামীলীগের বিশেষ কোন নেতার (এমপি হাচানুর রহমানকে ইঙ্গিত করে) ব্যক্তিগত সন্ত্রাসী বাহিনী বলে সভায় জানানো হয়। আবার প্রচারে বাঁধা, মাইক ফেলে দেয়াসহ নৌকার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন হাতপাখা প্রতীকের প্রার্থীরা।
অভিযোগুলো শোনার পর সভায় বরিশাল রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি এ.কে.এম এহসান উল্লাহ বলেন, পাথরঘাটা ইউপি নির্বাচনে প্রার্থীরা শতভাগ আচারনবিধি লংঘন করছেন। তারা সংশোধন না হলে প্রশাসন শক্তভাবে আইনী পদক্ষেপ নেবে।
৪টি ইউনিয়নের রির্টানিং অফিসার ও উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মোঃ আইউব আলী হাওলাদার জানান, এ পর্যন্ত তার দপ্তরে প্রার্থীদের অর্ধশতাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে। অভিযোগের সুনির্দিষ্ট প্রমান না থাকায় ব্যবস্থা নিতে পারছেন না ।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক অ্যাডভোকেট নুরুল ইসলাম বলেন, ইউপি নির্বাচনে পাথরঘাটায় দৃশ্যমান সহিংসতা নেই। তবে নৌকা ছাড়া অপর প্রতীকের প্রার্থীরা ভয়ে লুকিয়ে প্রচার চালাচ্ছেন। এখানে একতরফা নৌকার দাপট চলছে। আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় অন্য প্রতীকের প্রার্থীরা প্রচারে বাঁধা দেয়ার অভিযোগ করেছেন। প্রশাসন তাদের নিরাপত্তার আশ্বাস দিলেও প্রার্থীরা আশ্বস্ত হতে পারছেন না।
পটুয়াখালীর জেলার মধ্যে মীর্জাগঞ্জ উপজেলার ৬ ইউনিয়নের সবকটিতে ২৮ নভেম্বর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। মাধ্যমিক শিক্ষক সংগঠনের এক নেতা (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) জানান, কাকরাবুনিয়া ইউপিতে নৌকার প্রার্থী মাহবুবুল আলম স্বপন বিনাপ্রতিদ্বন্দিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। অপর ৫টি ইউনিয়নের মধ্যে মজিদবাড়িয়া ইউপিতে বিএনপির দলীয় স্বতন্ত্র এবং অপর ৪টিতে আওয়ামীলীগ দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নৌকার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে রয়েছেন। মসজিদবাড়ি ও মাধবখালীতে নির্বাচনী সহিংসতা নিত্যদিনের ঘটনা বলে ওই শিক্ষক নেতা জানিয়েছেন। তিনি জানান, এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে ভোটাররা কেন্দ্রে যাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন।
ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার ৭টিতে ২৮ নভেম্বর নির্বাচন হলেও ৫ ইউনিয়নে নৌকার প্রার্থীরা এরইমধ্যে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। ফলে নির্বাচনী উত্তাপ আছে শুধু চরকুকরিমুকরী ও ওসমানগঞ্জ ইউনিয়নে। ওসমানগঞ্জে নৌকার বিরুদ্ধে ইউনিয়ন আওয়ামীলীগ সভাপতি আবুল কাশেম মোল্লা স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ায় গোটা উপজেলার নির্বাচনী দৃষ্টি এখন এ ইউনিয়নের দিকে।
এদিকে পটুয়াখালীর দশমিনা উপজেলার ৪ ইউনিয়নে গত ১১ নভেম্বর প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন শেষ হলেও তার রেশ চলছে বলে জানিয়েছেন সদর ইউনিয়নে হাতপাখা প্রতীকের প্রার্থী মো. মুজিবুর রহমান। বেল্লাল নামক এক যুবক জানান, তিনি হাতপাখা প্রতীকের কর্মী হওয়ায় ভোটের পর তার বাবা মসজিদের ইমাম পদ থেকে চাকুরীচ্যুত হয়েছেন। এ পর্যন্ত ১০টির বেশী মসজিদের ইমাম-মোয়াজ্জেমকে চাকুরীচ্যুত করতে স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতারা মসজিদ কমিটিকে বাধ্য করেছেন বলে অভিযোগ প্রার্থী মুজিবুর রহমানের। এ উপজেলাতে ইভিএমে ভোটগ্রহন হলেও বুথের মধ্যে অবস্থান করা নৌকার এজেন্টরা চেয়ারম্যান প্রতীকের বুতামে চাপ দিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন ভোটার ও পরাজিত প্রার্থীরা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *