সালমান শাহ’র শূন্যতা এখনও

Spread the love

নাগরিক রিপোর্ট ॥ সালমান শাহর মৃত্যুর রহস্য আজও উদ্ঘাটিত হয়নি। সেদিনও ছিল আজকের মতো ছুটির দিন, শুক্রবার। আজ থেকে ঠিক ২৩ বছর আগে। ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর, ওই দিন শরতের সকালে সমকালীন ঢাকাই চলচ্চিত্র অঙ্গনে সব থেকে বড় শূন্যতা তৈরি করে বিদায় নিয়েছেন সালমান শাহ। যার পারিবারিক নাম শহীদ চৌধুরী মোহাম্মদ শাহরিয়ার ইমন। ১৯৭১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলায় জন্মগ্রহন করেন। তাঁর বাবা কমর উদ্দিন চৌধুরী ও মা নীলা চৌধুরী। সালমন ছিলেন পরিবারের বড় ছেলে।
এসেছিলেন ’৭১এ, চলে গেলেন ’৯৬তে। মাত্র ২৫ বছর। গড় আয়ুরও তুলনায় একেবারেই নগণ্য বয়স। এত অল্প সময়ে কেন চলে গেলেন তিনি, কেন চলে যেতে হলো, সে রহস্য এখনো উন্মোচিত হয়নি। চলছে বিচার। আসলে কী ঘটেছিল সেদিন, তা এখনো রহস্যের ভেতর আছে, তবে সেদিনের ঘটনাগুলো বিভিন্ন সময়ে নিকটজনদের বয়ানে পাওয়া যায়।
চিত্রনায়ক সালমান শাহ তখন থাকতেন রাজধানী ঢাকার নিউ ইস্কাটন রোডের ইস্কাটন প্লাজার একটি ফ্ল্যাটে। সেদিন সকাল সাতটায় বাবা কমর উদ্দিন চৌধুরী ছেলে শাহরিয়ার চৌধুরী ইমনের সঙ্গে দেখা করতে ইস্কাটনের বাসায় যান। কিন্তু ছেলের দেখা না পেয়ে তিনি ফিরে আসেন। সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে সালমান শাহর মা নীলা চৌধুরী বলেন, বাসার নিচে দারোয়ান সালমান শাহর বাবাকে তাঁর ছেলের বাসায় যেতে দিচ্ছিলেন না। নীলা চৌধুরীর বর্ণনা ছিল এ রকম, ‘বলেছে স্যার এখন তো ওপরে যেতে পারবেন না। কিছু প্রবলেম আছে। আগে ম্যাডামকে (সালমান শাহর স্ত্রীকে) জিজ্ঞেস করতে হবে। একপর্যায়ে উনি (সালমান শাহর বাবা) জোর করে ওপরে গেছেন। কলবেল দেওয়ার পর দরজা খুলল সামিরা (সালমান শাহর স্ত্রী)। উনি (সালমান শাহর বাবা) সামিরাকে বললেন, “ইমনের (সালমান শাহর ডাকনাম) সঙ্গে কাজ আছে, ইনকাম ট্যাক্সের সই করাতে হবে। ওকে ডাকো।” তখন সামিরা বলল, “ও তো ঘুমে।” তখন উনি বললেন, “ঠিক আছে আমি বেডরুমে গিয়ে সই করিয়ে আনি।” কিন্তু যেতে দেয়নি। আমার হাজব্যান্ড ঘণ্টা দেড়েক বসে ছিল ওখানে।’
বেলা এগারোটার দিকে একটি ফোন আসে সালমান শাহর মা নীলা চৌধুরীর বাসায়। ওই টেলিফোনে বলা হলো, সালমান শাহকে দেখতে হলে তখনই যেতে হবে। টেলিফোন পেয়ে নীলা চৌধুরী দ্রুত ছেলে সালমান শাহর বাসার দিকে রওনা হয়েছিলেন। তবে সালমানের ইস্কাটনের বাসায় গিয়ে ছেলে সালমান শাহকে বিছানার ওপর দেখতে পান নীলা চৌধুরী। এ বিষয়ে তাঁর বক্তব্য ছিল, ‘খাটের মধ্যে যেদিকে মাথা দেওয়ার কথা, সেদিকে পা। আর যেদিকে পা দেওয়ার কথা সেদিকে মাথা। পাশেই সামিরার (সালমান শাহর স্ত্রী) এক আত্মীয়ের একটি পারলার ছিল। সে পারলারের কিছু মেয়ে ইমনের হাতে-পায়ে সরিষার তেল দিচ্ছে। আমি তো ভাবছি ফিট হয়ে গেছে। আমি দেখলাম, আমার ছেলের হাতুপায়ের নখগুলো নীল। তখন আমি আমার হাজব্যান্ডকে বলেছি, আমার ছেলে তো মরে যাচ্ছে।’
ইস্কাটনের বাসা থেকে সালমান শাহকে হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানকার চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। এরপর ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে বলা হয়, সালমান শাহ আত্মহত্যা করেছেন। তবে বিষয়টি এখনো বিচারাধীন। সালমানের মৃত্যুর সঠিক কারণ জানতে না পারায় তাঁর ভক্তদের মধ্যে তৈরি হয় নানা প্রশ্নের।
বরাবরই পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, সালমান শাহকে হত্যা করা হয়েছে। নীলা চৌধুরীর অভিযোগ ছিল, তাঁরা হত্যা মামলা করতে গেলে পুলিশ সেটিকে অপমৃত্যুর মামলা হিসেবে নথিভুক্ত করে। পুলিশ বলেছিল, অপমৃত্যুর মামলা তদন্তের সময় যদি বেরিয়ে আসে যে এটি হত্যাকাণ্ড, তাহলে সেটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে হত্যা মামলায় মোড় নেবে।
চিত্রনায়িকা শাবনূরের সঙ্গে তাঁর জুটি জনপ্রিয় হয়েছিল।চিত্রনায়িকা শাবনূরের সঙ্গে তাঁর জুটি জনপ্রিয় হয়েছিল।আগের দিন বৃহস্পতিবার যা ঘটেছিল
৫ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় ‘প্রেমপিয়াসী’ ছবির ডাবিং করতে এফডিসিতে গিয়েছিলেন সালমান শাহ। সেখানে ডাবিংয়ের জন্য আগে থেকেই উপস্থিত ছিলেন এ ছবির নায়িকা শাবনূর। এফডিসিতে পৌঁছানোর কিছুক্ষণ পর সালমান বাবাকে ফোন করে বলেন, তাঁর স্ত্রী সামিরাকে নিয়ে এফডিসির সাউন্ড কমপ্লেক্সে আসার জন্য। ফোন পাওয়ার পরপরই সালমানের বাবা সামিরাকে নিয়ে এফডিসি আসেন। শ্বশুরের সঙ্গে সাউন্ড কমপ্লেক্সে এসে সামিরা দেখতে পান, সালমান ও শাবনূর ডাবিং রুমে খুনসুটি করছেন। ওই সময়ের বিনোদন বেশ কিছু বিনোদন পাক্ষিক পত্রিকা এবং সালমানকে নিয়ে লেখা একাধিক গ্রন্থে লেখা হয়েছে, সালমানকে শাবনূরের সঙ্গে খুনসুটি করতে দেখে রেগে যান সামিরা। সালমানের বাবা চলে যাওয়ার পর সামিরাও দ্রুত গাড়িতে ওঠেন। ‘অবস্থা জটিল’ বিষয়টি বুঝতে পেরে একই গাড়িতে ওঠেন সালমান শাহ ও চিত্রপরিচালক বাদল খন্দকার। কিন্তু গাড়িতে বসে সালমানের সঙ্গে কথা বলেননি সামিরা। তাঁকে বোঝাতে থাকেন বাদল খন্দকার। গাড়ি এফডিসির গেট পর্যন্ত গেলে সালমান প্রধান ফটকের সামনে নেমে যান। তাঁর সঙ্গে বাদল খন্দকারও নেমে পড়েন। এরপর সেখানে কিছুক্ষণ আড্ডা দেন। এরপর ডাবিং রুমে ফিরে গেলেও সেদিন আর ডাবিং হয়নি। পরে রাত ১১টার দিকে নিউ ইস্কাটন রোডের ইস্কাটন প্লাজার বি-১১ নম্বর ফ্ল্যাটে সালমানকে পৌঁছে দিয়ে বিদায় নেন বাদল খন্দকার। বাসায় ফেরার পর রাতের ঘটনা নিয়ে বিভিন্ন রকমের বক্তব্য পাওয়া যায় সে সময়ের পত্রিকাগুলোতে। তবে সেসব বক্তব্য প্রত্যক্ষদর্শী কারও বয়ানে ধারণ করা নেই। প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকার চলচ্চিত্র পরিচালক বাদল খন্দকার জানান, তিনি পরদিন সকালেই সালমানের বাসায় গিয়েছিলেন। বাদল খন্দকার প্রথম আলোকে বলেন, ছবির কাজের শিডিউল নিতে তিনি সকালে সেখানে গেলে বাসার নিচে দারোয়ানেরা তখন বলাবলি করছিলেন, সালমান রাতেই ফাঁস দিয়ে মারা গেছেন।
চলচ্চিত্র পরিচালক শাহ আলম বলেন, শেষের দিকে অনেক মানসিক চাপে ছিলেন সালমান শাহ। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন এবং প্রযোজকদের সঙ্গে বোঝাপড়ার ঘাটতি তৈরি হয়েছিল। কিছুদিন নিষিদ্ধ হয়েছিলেন সমিতির কাছে। ১৯৯৪ সাল। তখন সালমান শাহর বয়স মাত্র ২৩।১৯৯৪ সাল। তখন সালমান শাহর বয়স মাত্র ২৩।আজকের শুক্রবার যা ঘটছে
সালমান শাহ চলে গেছেন ২৩ বছর হয়ে গেল। তিনি ছিলেন তাঁর সময়ের থেকে এগিয়ে থাকা একজন নায়ক। সে সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ছিল না। এখন আছে। মৃত্যুর ২৩ বছর পরেও আজ শুক্রবার দারুণ উপস্থিতি সালমান শাহর। আজও যেন এই বাংলায় তিনি জনপ্রিয়তম নায়ক। বৃহস্পতিবার রাত ১২টার পর থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানান বয়েসী মানুষের ওয়ালে ভেসে উঠেছে সালমান শাহর ছবি। দেখা যাচ্ছে আবেগাপূর্ণ সব কথা। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিভিন্ন অঙ্গনের তারকাদের ফেসবুক পেজে সালমান শাহর উজ্জ্বল উপস্থিতি। অভিনেতা অপূর্ব ৩টি আলাদা ছবি দিয়ে লিখেছেন, ‘ কিংবদন্তির কখনো মৃত্যু নেই, শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি এই কিংবদন্তি নায়ককে।’ অভিনয়শিল্পী জামশেদ শামীম সালমান শাহর একটি স্কেচ শেয়ার করে লিখেছেন, ‘সালমান শাহ…ঢাকাই চলচ্চিত্র ইতিহাসের একটি আফসোস!’ সাবরিনা সুলতানা সোনিয়া লিখেছেন, ‘১৯৯৬ সালের এই দিনে আমার প্রথম ভালোবাসার মৃত্যু হয়েছিল, আজও মনে দাগ কেটে আছে।’ এমন আরও অসংখ্য মন্তব্য–ছবি ভেসে বেড়াচ্ছে অনলাইন দুনিয়ায়।
আজ ২৩ বছর হলো মারা গেছেনআজ ২৩ বছর হলো মারা গেছেনআজও শুক্রবার। আজও ৬ সেপ্টেম্বর। ২৩ বছর আগে ঢাকায় চলচ্চিত্রে রাজত্ব করা মানুষটি আজ অনতিক্রমণীয় দূরত্বে। তিনি কী দেখছেন ছেড়ে যাওয়া ভক্ত ও অনুরাগীরা কী গভীর শ্রদ্ধা আর নিখাদ ভালোবাসায় স্মরণে রেখেছে তাঁকে? এ প্রশ্নের উত্তর কারও জানা নেই। তবে তিনি বেঁচে থাকবেন ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’, ‘তুমি আমার’, ‘অন্তরে অন্তরে’, ‘বিক্ষোভ’, ‘প্রেমযুদ্ধ’, ‘দেনমোহর’, ‘স্বপ্নের ঠিকানা’, ‘আঞ্জুমান;, ‘বিচার হবে’, ‘এই ঘর এই সংসার’, ‘স্বপ্নের পৃথিবী’, ‘সত্যের মৃত্যু নেই’, ‘জীবন সংসার’, ‘মায়ের অধিকার’, ‘চাওয়া থেকে পাওয়া’, ‘আনন্দ অশ্রু’র মতো ব্যবসা সফল চলচ্চিত্রের ভেতর; নিজ অভিনয় গুণে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *