করোনা মোকাবিলায় বিশ্বসেরা যে দেশ

Spread the love

নাগরিক রিপোর্ট: বিশ্ব তখনো চীন থেকে ছড়িয়ে পড়া করোনা ভাইরাসের সংকট সম্পর্কে পুরোপুরি সতর্ক হয়ে উঠেনি। ভাইরাসটি নিয়ে পুরো বিশ্বের নজর মূলত চীনের উপরই। এর মধ্যেই, ২৫শে জানুয়ারি চীনের বাইরে দুটি দেশে নতুন চারটি সংক্রমণ ধরা পড়লো- অস্ট্রেলিয়া ও তাইওয়ানে। উভয় দেশের জনসংখ্যাই কাছাকাছি, প্রায় ২ কোটি ৪০ লাখ। দুটিই দ্বীপরাষ্ট্র। সীমান্তের উপর উভয় দেশেরই কঠোর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। চীনের মূল ভূখন্ডের সঙ্গে উভয় দেশেরই বাণিজ্যিক ও পরিবহণ যোগাযোগ রয়েছে।
সকল সাদৃশ্য বিবেচনায় নিয়ে, ভাইরাসটির সংক্রমণ দুই দেশে কাছাকাছি হওয়ার কথা। কিন্তু ১৪ সপ্তাহ পর, বর্তমানে উভয় দেশে করোনা পরিস্থিতি অনেকটাই আলাদা। অস্ট্রেলিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা ৬ হাজার ৫০০ ছাড়িয়েছে। অন্যদিকে তাইওয়ানে সংক্রমিত হয়েছেন ৪০০ জনেরও কম। এখানে, অস্ট্রেলিয়া কী ভুল করেছে সেটা প্রশ্ন নয়। প্রশ্ন হচ্ছে, তাইওয়ান কী ঠিক করেছে?
জন হপকিন্স অনুসারে, বিশ্বে করোনা আক্রান্ত দেশের তালিকায় অস্ট্রেলিয়ার অবস্থান ৩৮ তম। তালিকার শীর্ষে থাকা যুক্তরাষ্ট্রে আক্রান্তের সংখ্যা ৭ লাখের বেশি। এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশন হচ্ছে, পুরো বিশ্ব যখন ভাইরাসটির সংক্রমণ রোধে ব্যর্থ হচ্ছে, তাইওয়ান তখন এতে এত সফল কেন?
কঠিন শিক্ষা:
২০০৩ সালে সারস করোনা ভাইরাসে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত দেশগুলোর একটি ছিল তাইওয়ান। এর পাশাপাশি চীনের দক্ষিণাঞ্চল ও হংকংয়েও এর প্রভাব বেশি ছিল। তাইওয়ানের ক্ষেত্রে সে সময় কোয়ারেন্টিন করা হয়েছিল দেড় লাখ মানুষকে। এদের মধ্যে ১৮১ জনের মৃত্যু হয়। সে সময় থেকে শিক্ষা নিয়েছে দেশটি। এবার আগেভাগে আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে কভিড-১৯ মোকাবিলা করেছে। ১লা ফেব্রুয়ারির মধ্যে চীনের সঙ্গে সীমান্ত পারাপার বন্ধ করে দেয় তাইওয়ান ও হংকং সরকার। সারস সংক্রমণের সময় দেশজুড়ে স্থাপন করা হয় কমান্ড সেন্টার দ্রুত পদক্ষেপ নেয়। ভাইরাস শনাক্ত ও সম্ভাব্য আক্রান্তদের ধরতে মোতায়েন করা হয় বিশাল সংখ্যার কর্মী। কঠোর করা হয় কর্মস্থল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাওয়ার নিয়ম।
মেডিক্যাল সাময়িকী দ্য জার্নাল অব দ্য আমেরিকান মেডিক্যাল এসোসিয়েশন (জামা) এক প্রতিবেদনে জানায়, তাইওয়ানের স্বাস্থ্যব্যবস্থা বিশ্বের মধ্যে প্রথম শ্রেণির। লুনার নববর্ষের আগ দিয়ে উহান থেকে ভাইরাসটি ছড়ানোর খবর প্রকাশের পরপরই তাইওয়ানের জাতীয় স্বাস্থ্য কমান্ড সেন্টার (এনএইচসিসি) সম্ভাব্য হুমকি মোকাবিলায় পদক্ষেপ নেয়া শুরু করে।
স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির পেডিয়াট্রিকস বিষয়ক তাইওয়ানিজ চিকিৎসক ও অধ্যাপক জেসন ওয়াং জামা’র ওই প্রতিবেদনের একজন লেখক। তিনি এক বিবৃতিতে বলেন, তাইওয়ান দ্রুত হারে পাঁচ সপ্তাহের মধ্যে জনস্বাস্থ্য বিষয়ক অন্তত ১২৪টি প্রটোকল বাস্তবায়ন করে। ওইসব নীতিমালা ও পদক্ষেপ কেবল সীমান্ত নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই সীমিত নয়। তারা বুঝেছিল, সেটুকু পর্যাপ্ত নয়।
প্রাথমিক পর্যায়ে, তাইওয়ান চীনের অনেকাংশের সঙ্গে ভ্রমণ নিষিদ্ধ করে দেয়। দেশটির বন্দরগুলোয় প্রমোদতরী নোঙ্গর নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। হোম কোয়ারেন্টিন লঙ্ঘন ও গুজব ছড়ানোর বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি চালু করা হয়। এসবের পাশাপাশি, দেশে ফেস-মাস্ক উৎপাদন বৃদ্ধি করে, ভাইরাস শনাক্তে পুরো দেশজুড়ে শুরু হয় পরীক্ষা করা। কয়দিন আগে যারা অব্যাখ্যাত নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন, তাদেরও পরীক্ষা করা হয়।
এই সময়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলো পদক্ষেপ নিবে কিনা সে ব্যাপারে সংশয়ে ছিল। জন হপকিন্স ইউনিভার্সিটির জানুয়ারিতে করা এক জরিপ অনুসারে, চীনের মূল ভূখণ্ডের বাইরে করোনায় সবচেয়ে ঝুকিপূর্ণ দেশগুলোর একটি ছিল তাইওয়ান। ওয়াং তার প্রতিবেদনে লিখেন, প্রাথমিক পর্যায়ে নেয়া তাদের ওইসব দ্রুত গতিতে নেয়া পদক্ষেপগুলোই তাদের সফলতার পেছনের রহস্য।
প্রতিবেদনটি অনুসারে, তাইওয়ানের সরকার ২০০৩ সালের সারস মহামারি থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেছে। পরবর্তী সংকটের সময় দ্রুত পদক্ষেপ নিতে একটি জনস্বাস্থ্য পদ্ধতি স্থাপন করেছে। উচ্চ-শিক্ষিত ও অভিজ্ঞতা কর্মীদের দল দ্রুত সংকটটির অবস্থা ধরতে পেরেছে ও আসন্ন মহামারি ঠেকাতে জরুরি ব্যবস্থাপনা কাঠামো চালু করেছে।
বিশেষ করে, তাইওয়ানের দ্রুত ও স্বচ্ছ পদক্ষেপ গ্রহণ পদ্ধতি- প্রতিদিন সংকটটি নিয়ে স্বাস্থ্যকর্মীদের ব্রিফিং- এর মাধ্যমে দেখিয়েছিল, বিশ্বজুড়ে মহামারির সময়ও কিভাবে গণতন্ত্র তার প্রভাব বজায় রাখতে পারে। সেসময় অনেকেই দাবি করছিল, কেবলমাত্র চীনের মতো স্বৈরাচারী সরকারই ভাইরাসটির সংক্রমণ কার্যকরীভাবে, দ্রুত হারে রোধ করতে সক্ষম। অন্যদিকে, তাইওয়ান ভাইরাসটি নিয়ন্ত্রণে রাখতে চীন ও অন্যান্য দেশের মতো লকডাউনও জারি করেনি।
বর্তমানে করোনা মোকাবিলায় তাইওয়ানের অবস্থান এতটাই মজবুত যে, দেশটি অন্যান্য দেশে ফেস-মাস্ক রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছে। জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রে ১ কোটি সহ অন্যান্য দেশে ফেস-মাস্ক রপ্তানি করবে। সর্বশেষ তথ্যানুসারে, তাইওয়ানে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা মাত্র ৩৯৮ জন। আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন মাত্র ৬ জন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *