নাগরিক ডেস্ক :অনেকে হয়তো জানেনই না যে, বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের বর্তমান সভাপতি, একসময়ের সুপারস্টার কাজী সালাউদ্দিনকে কারাবরণ করতে হয়েছিল। অনেকেই এই দিনটিকে বর্ণনা করেন বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসের ‘কলঙ্কময় দিন’ হিসেবে। কারও কাছে এটি ‘কালো দিন’, আবার অনেকের ভাষায় ‘ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর’। সেদিন ওই সময়ের তুমুল জনপ্রিয় দুই ক্লাব আবাহনী এবং মোহামেডানের মধ্যে একটি ফুটবল ম্যাচকে ঘিরে এক ধুন্দুমার কাণ্ড ঘটেছিল, যা গড়ায় সামরিক আদালতে।
ওই বছর ঢাকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফুটবল লিগের শেষ খেলাটি ছিল আবাহনী ও মোহামেডানের মধ্যে। বাংলাদেশের ফুটবলে তখন আবাহনী ক্রীড়া চক্র এবং মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব ছিল পরস্পরের তুমুল প্রতিন্দ্বন্দ্বী। যেদিন এই দুটো দলের মধ্যে খেলা হতো, সেদিন সেই উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়তো পুরো দেশজুড়ে। একুশে সেপ্টেম্বর দিনটিও ব্যতিক্রম ছিল না। ঢাকা লিগের পয়েন্ট টেবিলের বিচারে অবশ্য ম্যাচটির তেমন কোনো গুরুত্ব ছিল না। কারণ, মোহামেডান এরই মধ্যে তাদের চ্যাম্পিয়নশিপ নিশ্চিত করেছে। অন্যদিকে, আবাহনীও দ্বিতীয় স্থানটি দখল করে নিয়েছে।
তাই সেই ম্যাচের জয় পরাজয় চ্যাম্পিয়ন কিংবা রানার্সআপ পজিশন নির্ধারণে কোন ভূমিকা রাখতো না। কিন্তু তারপরেও আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচ বলে কথা – সেই ম্যাচে জয়লাভ করা ছিল ক্লাবের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, সমর্থকদের জন্যও বহুল আকাঙ্ক্ষিত। কারণ, এটি ছিল এক ধরণের প্রেস্টিজ ইস্যু। বরাবরের মতোই সে ম্যাচের আগে স্টেডিয়ামের ভেতরে এবং বাইরে পুলিশের দিক থেকে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছিল। অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, এই দুই দলের ম্যাচের সময় উত্তেজনা গ্যালারি এবং স্টেডিয়ামের বাইরে রাস্তায় ছড়িয়ে যায়।
বিকেলে নির্ধারিত সময়ে বর্তমান বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে মুখোমুখি হয় আবাহনী ও মোহামেডান। খেলার এক পর্যায়ে মোহামেডান ১-০ গোলে এগিয়ে যায়। গোল পরিশোধের জন্য উন্মুখ হয়ে ওঠে আবাহনী। আক্রমণ ও পাল্টা আক্রমণ কেঁপে ওঠে দুই দল। খেলা শেষ হওয়ার ১০ মিনিট আগে কাজী আনোয়ার হোসেনের একটি শট মোহামেডানের গোলরক্ষক মোহাম্মদ মহসীন ধরে ফেলেন, কিন্তু বল গোল লাইন অতিক্রম করেছিল বলে আবাহনীর খেলোয়াড়রা দাবি করতে থাকেন।
কিন্তু রেফারি এই দাবি প্রত্যাখ্যান করায় আবাহনীর খেলোয়াড়রা তার কাছে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য আবেদন জানান। আবাহনীর কিছু খেলোয়াড় এ সময় মাঠে উত্তেজিত হয়ে পড়েন। সেদিনের ঘটনাবলী স্মরণ করে কাজী আনোয়ার হোসেন জানান, ‘দুই গ্যালারিতে সমর্থকেরা মারামারি করেন, আর এরপর বায়তুল মোকাররম-গুলিস্তান এলাকায় সমর্থকরা সংঘর্ষে জড়িয়ে উত্তেজনার বশে বেশ ভাঙচুর করেছিল।’
এছাড়া ১৯৯৭ সালের ১৬ই জুলাই প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে আশরাফ উদ্দিন চুন্নু বলেছিলেন, ‘কাঁটাতারের ফেন্সিং টপকে পিঁপড়ের সারির মতো অগণিত দর্শক মাঠে ঢুকে পড়ে। উত্তেজিত দর্শকদের নিবৃত্ত করতে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়ে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। খেলা ভণ্ডুল হয়ে যায়।’
তখন এশিয়ান গেমসের প্রস্তুতির জন্য জাতীয় দলের ফুটবল ক্যাম্প চলছিল। আবাহনী এবং মোহামেডানের অনেক খেলোয়াড় সেই ক্যাম্পে ছিলেন। রাত বারোটার পরে পুলিশ শহরের কয়েকটি জায়গায় অভিযান শুরু করে আবাহনীর খেলোয়াড়দের গ্রেপ্তার করার জন্য। তার অংশ হিসেবে আবাহনী ক্লাব, খেলোয়াড়দের বাসা এবং জাতীয় ফুটবল দলের ক্যাম্পেও অভিযান চালানো হয়। যেভাবে তাদের ঘুম থেকে তুলে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, মনে হচ্ছিল তারা বিরাট কোন অপরাধী। এটাই ছিল সবচেয়ে অবাক কাণ্ড। কী কারণে তাদের এভাবে গ্রেপ্তার করা হলো? অনেকে ছিলেন তখন জাতীয় দলের ক্যাম্পে।
আশরাফ উদ্দিন চুন্নু সেই রাতে জাতীয় ফুটবল দলের ক্যাম্পে ছিলেন। তিনি বলেন, ‘রাত আড়াইটার দিকে হঠাৎ দরজায় তীব্র আঘাতের শব্দ পেলাম। ঘুম-ঘুম চোখে লাফ দিয়ে উঠে দেখি পোশাকধারী কিছু পুলিশ। তাদের হাতে জাতীয় দলের ক’জন ফুটবলারের তালিকা। আশ্চর্য হলাম, তালিকার সব খেলোয়াড়ই আবাহনী ক্রীড়া চক্রের। আগত পুলিশ দল মশারী টেনে তুলে নাম ধরে ধরে তালিকাবদ্ধ ফুটবলারদের ঘুম থেকে জাগাল।’
গ্রেপ্তার করে ফুটবলারদের থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। সে সময় আবাহনী ক্রীড়া চক্রের খেলোয়াড় শ্রীলঙ্কার পাকির আলী ও আশোকাকেও আটক করা হয়। পরে শ্রীলঙ্কার ঢাকাস্থ দূতাবাসের হস্তক্ষেপে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। উশৃঙ্খল আচরণ এবং সহিংসতায় জড়িত থাকার অভিযোগে বেশ কিছু দর্শককেও আটক করা হয় ওই সময়। এরপর সালাউদ্দিনদের সামরিক আদালতে তোলা হয়। সামরিক আদালতে কোন ফুটবলারের বিচার ছিল নজিরবিহীন ঘটনা। ফুটবলারদের বিরুদ্ধে সরকার উৎখাত করার ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনা হয়েছিল।
এই ঘটনার ছয় মাস আগে তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল এইচ এম এরশাদ রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছিলেন। বাংলাদেশে তখন সামরিক শাসন চলছিল। ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র হতে পারে, অভিনব এ অভিযোগ শুনে সবাই হতবাক হয়ে যায়। পরের দিন ২২শে সেপ্টেম্বর রাতে ঢাকার মিন্টো রোডে স্থাপিত একটি সামরিক আদালতে নেয়া হয় ফুটবলারদের। আদালতে ফুটবলারদের সবাই নিজেদেরকে নির্দোষ দাবি করেন। তবে সামরিক আদালত চার ফুটবলারকে দোষী সাব্যস্ত করে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়।
এদের মধ্যে কাজী আনোয়ার হোসেনকে এক বছর এবং গোলাম রাব্বানী হেলালকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দিয়েছিল আদালত। এছাড়া, কাজী সালাউদ্দিন এবং আশরাফ উদ্দিন চুন্নুকে দেওয়া হয় এক মাসের কারাদণ্ড। ফুটবলারদের গ্রেপ্তার এবং সাজা দেওয়ার খবর বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হলে মানুষের মধ্যে এক ধরণের ক্ষোভ তৈরি হয়। পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে কাজী সালাউদ্দিন এবং আশরাফ উদ্দিন চুন্নুকে যশোর কারাগারে এবং কাজী আনোয়ার হোসেন ও গোলাম রাব্বানী হেলালকে রাজশাহী কারাগারে পাঠানোর আয়োজন করা হয়।
কমলাপুর স্টেশন থেকে রাতের একটি ট্রেনে করে কাজী সালাউদ্দিন ও আশরাফ উদ্দিন চুন্নুকে যশোর কারাগারে পাঠানোর কথা ছিল।এই খবর ছড়িয়ে পড়ার পর শতশত মানুষ কমলাপুর রেলস্টেশনে ভিড় করতে থাকে। সে ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে আশরাফ উদ্দিন চুন্নু বলেন, ‘আমাদেরকে স্টেশনে রাখা নিরাপদ নয় এই ভেবে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে পুলিশ পুনরায় রমনা থানায় নিয়ে এলো। উৎসুক জনতার ভিড়ের ফলে রমনা থানার আশপাশে ১৪৪ ধারা জারি হলো।’
শেষ পর্যন্ত ফুটবলারদের অবশ্য পরে ঢাকার বাইরে কারাগারে পাঠানো হয়েছিল। ফুটবলারদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হলেও প্রচণ্ড সমালোচনার মুখে ১৭ দিন পরেই তৎকালীন সামরিক সরকার সবাইকে মুক্তি দেয়। কাজী আনোয়ার হোসেন মনে করেন, ‘এটা ছিল ষড়যন্ত্রমূলক, যার বদৌলতে আমাদের জেল খাটতে হয়েছে। শেখ কামালের গঠন করা আবাহনী এতো তাড়াতাড়ি যশ-খ্যাতি লাভ করেছে, এরশাদ সেটা পছন্দ করেননি।’
একুশে সেপ্টেম্বরে খেলার মাঠে দর্শকদের মধ্যে সহিংসতা হলেও খেলোয়াড়দের মধ্যে কোন সংঘাত হয়নি। কিন্তু ঘটনার পর অস্বাভাবিক দ্রুততায় সামরিক আদালতের মাধ্যমে ফুটবলারদের সাজা দেয়া হয়। সে কারণেই ১৯৮২ সালের ২১শে সেপ্টেম্বরের ঘটনাকে অনেকে ‘ফুটবলের কালো দিবস’ হিসেব বর্ণনা করেন।
– বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন অবলম্বনে